শুক্রবার   ১১ জুলাই ২০২৫ , ২৬ আষাঢ় ১৪৩২

নিজস্ব প্রতিবেদক:

প্রকাশিত: ১০:৫৪, ২৯ অক্টোবর ২০২৪

আপডেট: ০৮:৪৯, ৩০ অক্টোবর ২০২৪

এই সরকারের মূল সমস্যা রাষ্ট্র পরিচালনার স্টাইল: ড. হোসেন জিল্লুর রহমান

এই সরকারের মূল সমস্যা রাষ্ট্র পরিচালনার স্টাইল: ড. হোসেন জিল্লুর রহমান

এই সরকারের মূল সমস্যা হচ্ছে  রাষ্ট্র পরিচালনার স্টাইল। সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকের সঙ্গে আলাপকালে এই মন্তব্য করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান।

সরকারের আকার নয়, পরিষদের কর্মকাণ্ডের সংশোধনের উপর গুরুত্ব আরোপ করে ছোটখাটো দুর্নীতি নিয়ে ব্যস্ত না থেকে অর্থনৈতিক কাজগুলোকে কীভাবে আরও সচল করা যায়, সেদিকে আরও বেশি মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান। অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মকাণ্ড সামগ্রিক কোনো আস্থার পরিবেশ তৈরি করছে না বলে মনে করেন ড. জিল্লুর। আমলা, বিশেষজ্ঞ ও ছাত্রদের ওপর অতি নির্ভরশীলতার ঘেরাটোপে ঘুরপাক খাচ্ছে এই সরকার। অর্থনীতির চাকাকে চাঙা করা, কর্মসংস্থান ত্বরান্বিত করা, বিনিয়োগ বাড়ানো, দ্রব্যমূল্য সহনীয় করার জন্য বাজার ব্যবস্থাপনার উন্নতি করার দিকে নজর দিতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। সম্প্রতি দেশ পরিবর্তনের এটাই শেষ সুযোগ বলে যে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান ড. ইউনূস তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে ড. জিল্লুর বলেন,  ‘আসলে শেষ সুযোগ বলে কিছু নেই। সুযোগ সব সময় থেকেই যায়।’

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, কোটা সংস্কার দিয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাত। কোটা সংস্কারের মূল লক্ষ্য ছিল কর্মসংস্থান; কিন্তু বর্তমানে কর্মসংস্থানের অবস্থা নিয়ে প্রশ্ন করলে আমরা কী উত্তর পাব? এ ব্যাপারে মনোযোগ কোথায়, উদ্যোগ কোথায়? 

আবারো উপদেষ্টা পরিষদের আকার বাড়ানো হতে পারে এমন সম্ভাবনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকারের আকার নয়, কার্যকারিতার মানদণ্ডে পরিষদকে বিচার করা ও তার সংশোধন করাই বেশি জরুরি।

দুর্নীতি অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় এবং একে অবশ্যই ন্যূনতম পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হবে, এ কথা স্বীকার করে জিল্লুর রহমান বলেন,  ‘কিন্তু পুরো পরিস্থিতিকে শুধু দুর্নীতির লেন্স দিয়ে দেখলে হবে না। গুরুতর দুর্নীতির কিছু ক্ষেত্র চিহ্নিত করে বাকি অর্থনৈতিক কাজগুলোকে কীভাবে আরও সচল করা যায়, সেদিকে আরও বেশি মনোযোগ দিতে হবে। শেয়ারমার্কেট কেলেঙ্কারি, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি, সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড ইত্যাদির রিপোর্ট এখনো প্রকাশ করা হয়নি; কিন্তু অনেক ছোটখাটো দুর্নীতির বিষয় নিয়ে সরকারকে ব্যস্ত থাকতে দেখছি।’

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়া ছাত্রদের ইমোশনাল হিলিংয়ের উপর জোর দিয়ে ড. রহমান বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রমে ফেরানোর কাজে গুরুত্ব না দিয়ে কে দোষী, কে দোষী নয়—এ নিয়ে এক অনিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে। আমি মনে করি, বিচার সঠিকভাবে হলে যারা অপরাধী, তাদের কাছেও তো এই বার্তা চলে যাবে যে সঠিক বিচার হচ্ছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের অপরাধ কমে আসবে।’

বর্তমান পরিস্থিতিতে বিভিন্ন গোষ্ঠী তাদের এজেণ্ডা বাস্তবায়ন করতে চাইবে। সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখার আহ্বান জানান সাবেক এই উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘বিশেষ গোষ্ঠী নয়, গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী প্রত্যক্ষ ও নীরব সমর্থনদানকারী সব গোষ্ঠী ও ব্যক্তির সর্বজনীন আকাঙ্ক্ষাকে ধ্রুবতারার মতো সামনে রাখা এই মুহূর্তে অত্যন্ত জরুরি। তিনটি আকাঙ্ক্ষা এখানে সর্বজনীন। প্রথমত, দৈনন্দিন সমস্যার সহনীয় সমাধান ও সমাধানের দৃশ্যমান ও কার্যকর চেষ্টা, 
দ্বিতীয়ত স্থিতিশীল পরিবেশ ও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে অন বোর্ড রাখতে কার্যকর বয়ান নির্মাণ। এটি শুধু সদিচ্ছা প্রকাশ করার ব্যাপার নয়। এক অর্থে এটি একটি সক্ষম ও বিশ্বাসযোগ্য রাজনৈতিক হ্যান্ডলিংয়ের ব্যাপার। 
তৃতীয়ত, টেকসই ও নৈতিকতার ছাপ আছে এমন রাজনৈতিক উত্তরণের রোডম্যাপ তৈরি।’

তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার আলাদা আলাদা অনেক উদ্যোগ নিচ্ছে; কিন্তু এসব উদ্যোগ সামগ্রিক কোনো আস্থার পরিবেশ তৈরি করছে বলে মনে হয় না। অন্তর্বর্তী সরকারের কাজের স্টাইল দৃশ্যত আমলা, বিশেষজ্ঞ ও ছাত্রদের ওপর অতি নির্ভরশীলতার ঘেরাটোপে ঘুরপাক খাচ্ছে।’

রাষ্ট্রপতি বিতর্ক এবং সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘যে সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় আমরা এই মুহূর্তে আছি, সেখানে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায় ছেদ তৈরি প্যান্ডোরার বাক্স খুলে দেবে, যা অপ্রয়োজনীয় বিশৃঙ্খলাকেই উসকে দিতে পারে।’ 

নতুন করে সংবিধান লেখার যে আলোচনা উঠেছে তার সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘শূন্য থেকে শুরু করা এখানে বিবেচ্য বিষয় নয়। সাংবিধানিক শূন্যতা রাজনৈতিক উত্তরণের জন্য মারাত্মক হুমকি। আমার দৃষ্টিতে সংবিধান-সংক্রান্ত আলোচনার লক্ষ্যবস্তু হওয়া উচিত তিনটি দিক বা বিষয়ে। প্রথমটি হলো মানুষের মৌলিক অধিকারের নতুন ও সম্প্রসারিত সংজ্ঞা নিশ্চিত করা। এই সম্প্রসারিত সংজ্ঞার অন্যতম বিবেচ্য মানুষের মর্যাদা নিশ্চিত করা। মানুষের মর্যাদার অধিকারগুলো সংজ্ঞায়িত ও যুক্ত করে সংবিধানের ধারাগুলো সাজাতে হবে। ধারাবাহিকতা ও মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে সমন্বয় করে আমাদের এ কাজ করতে হবে। কার্যকরভাবে ক্ষমতার ভারসাম্য কীভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায়, সেটা নিয়ে ভাবতে হবে। এখানেও চটজলদি কোনো সিদ্ধান্ত সুবিবেচনাপ্রসূত হবে না।’ 

আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক ইত্যাদি থেকে সহায়তা পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শুধু ঘোষণা ও আমলাতান্ত্রিক আশ্বাসের মধ্যেই যেন এগুলো আটকে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। 

তিনি বলেন, এসব ঋণের মাধ্যমে যেন কার্যকরভাবে অর্থনীতির চাকাকে আরও চাঙা অবস্থায় ফেরানো যায়; যাতে কর্মসংস্থান ত্বরান্বিত হতে পারে, বিনিয়োগ বাড়তে পারে, দ্রব্যমূল্য সহনীয় করার জন্য বাজার ব্যবস্থাপনার উন্নতি হতে পারে সেদিকে নজর দিতে হবে।

সম্প্রতি দেশ পরিবর্তনের এটাই শেষ সুযোগ বলে যে মন্তব্য করেছেন ড. ইউনূস তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেনড. জিল্লুর বলেন,  ‘আসলে শেষ সুযোগ বলে কিছু নেই। সুযোগ সব সময় থেকেই যায়। কোনো কারণে কোনো কিছু বাধাগ্রস্ত হলেও বাংলাদেশের মানুষের পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা রয়ে যাবে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জনগণের মনে অনেক পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। সেই সঙ্গে সুযোগও তৈরি হয়েছে। সরকার যাতে জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী ভালোমতো সেই কাজগুলো করতে পারে, সে জন্য আমাদের চেষ্টা করে যেতে হবে। তবে এটাই শেষ সুযোগ—এমন ধারণার সঙ্গে আমি একমত নই। বাংলাদেশের মানুষ সব সময় তার ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য চেষ্টা করে গেছে, ভবিষ্যতেও তারা তা-ই করবে।’

সর্বশেষ

জনপ্রিয়