ই-কমার্স শুধু সেক্টর নয়, নতুন অর্থনীতির রূপকার হবে

(ড. মোহাম্মদ নুরুজ্জামান, ড্যাফোডিল ফ্যামিলির গ্রুপ সিইও, গ্রীন ডাটা লিমিটেডের চেয়ারম্যানের দায়িত্বেও আছেন। সেই সঙ্গে ডকটাইম লিমিটেডের কো-ফাউন্ডার এবং পরিচালকের পদেও রয়েছেন । আসন্ন ই-ক্যাব নির্বাচনে পরিচালক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তিনি। বাংলাদেশের ই-কর্মাস অর্থনীতিকে আরো উন্নতর স্তরে পৌছে দিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ এই কর্পোরেট বিশেষজ্ঞ। এই লেখায় নিজের সেই চিন্তাধারার কথাই তুলে ধরেছেন তিনি)
ই-কমার্স ইকোনমি এমন একটি ডিজিটাল অর্থনীতি, যা অনলাইনভিত্তিক ব্যবসা, ডিজিটাল পেমেন্ট, ডেলিভারি সেবা, উদ্যোক্তা উন্নয়ন, দক্ষতা উন্নয়ন ও ব্যবহার এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে একত্রে সংযুক্ত করে।
এটি কেবলমাত্র কেনাবেচার একটি মাধ্যম নয়—বরং এটি একটি সমন্বিত অর্থনৈতিক ইকোসিস্টেম, যা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে, রাজস্ব বাড়ায়, রপ্তানি সম্ভাবনা তৈরি করে, এবং অর্থনীতিকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও প্রযুক্তিনির্ভর করে তোলে।
আমার বিশ্বাস বাংলাদেশে ই-কমার্স ইকোনমি গড়ে উঠলে, মাইক্রো ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা জিডিপিতে বিপুল পরিমান অবদান রাখতে পারবে। নারী উদ্যোক্তার হার বাড়বে। প্রযুক্তিনির্ভর রাজস্ব আসবে। সর্বপরি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে প্রবেশাধিকার সহজতর হবে। ই-কমার্সকে শুধু সেক্টর নয়, ‘নতুন অর্থনীতির রূপকার’ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।
প্রশ্ন উঠতেই পারে এতদিন বাংলাদেশে ই-কমার্স জিডিপিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারছে না কেন? এই প্রশ্নের উত্তরটা একটু বড় হবে।
মুলত বাংলাদেশের ই-কমার্স খাত এখনও জিডিপি’র আনুষ্ঠানিক পরিসংখ্যানে সঠিকভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে না, তার প্রধান কারণগুলো হলো:
১) অনেক ব্যবসা এখনো ইনফর্মাল—Facebook based ফরম্যাটে চলছে, যেখানে ট্রেড লাইসেন্স, BIN, VAT নেই।
২) লেনদেন মূলত ক্যাশ-অন-ডেলিভারি ভিত্তিক—ব্যাংকিং বা ডিজিটাল ট্র্যাক রেকর্ডে ঢুকে না।
৩) সঠিক ব্যবসা ডেটার ঘাটতি—সরকার, e-CAB বা BBS-এর কাছে কোনো কেন্দ্রীয় ডেটাবেইস নেই।
৪) নীতিগত স্পষ্টতা ও প্রণোদনার অভাব—ফলস্বরূপ উদ্যোক্তারা ফর্মালাইজ হতে আগ্রহ পান না
এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে যা প্রয়োজন-
Smart BDID চালু করা। ডিজিটাল পেমেন্টের গ্রহণযোগ্যতা ও প্রণোদনা বাড়ানো। e-CAB এর মাধ্যমে একটি জাতীয় e-commerce ডেটা ড্যাশবোর্ড গঠন করতে হবে। অনেকে হয়তো বলতে পারেন BDID তো অলরেডি আছে, তাহলে Smart BDID কেন প্রয়োজন?
দেখুন, Smart BDID (Business Digital Identity) একটি ইউনিক ডিজিটাল ব্যবসা পরিচিতি, যা একজন উদ্যোক্তার যাবতীয় তথ্য একক আইডিতে যুক্ত করবে। এর প্রয়োজনীয়তা বহুমুখী। একজন উদ্যোক্তা এখন ট্রেড লাইসেন্স, TIN, BIN, পেমেন্ট, কুরিয়ার, মার্কেটপ্লেস—সবখানেই আলাদা আলাদা রেজিস্ট্রেশন করতে বাধ্য হন। ফলে তার এবং প্রাপক উভয়ের সময়, খরচ ও জটিলতা বাড়ে।
পাশাপাশি সরকার কোনো নির্ভরযোগ্য ও একীভূত তথ্য পায় না। অন্যদিকে Smart BDID চালু হলে
ব্যবসার রেজিস্ট্রেশন সহজ ও স্বয়ংক্রিয় হবে
উদ্যোক্তা সহজেই e-CAB, ব্যাংক ও সরকারিভাবে স্বীকৃতি পাবে। রেজিস্টার্ড উদ্যোক্তারা প্রণোদনা, ট্রেনিং, লোন ও ভ্যাট ইনসেনটিভ পাবে। সরকার ও নীতিনির্ধারকরা ডেটা-চালিত সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। এক কথায় যদি বলি তাহলে বলতে হবে এটি হবে ‘এক ব্যবসা, এক আইডি’নীতির সঠিক এবং বাস্তবসম্মত বাস্তবায়ন।
‘গ্লোবাল বাংলাদেশ’ হলো এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি—যেখানে বাংলাদেশি পণ্য ও সেবা আন্তর্জাতিক বাজারে পৌঁছায়, এবং বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা বিশ্ব প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। ই-কমার্স হলো এই ভিশন বাস্তবায়নের সবচেয়ে সহজ ও সম্ভাবনাময় পথ।
কারণ, Shopify, Amazon, Etsy, eBay-এর মতো প্ল্যাটফর্মে দেশের পণ্য বিক্রি করা যায়।
আমাদের জামদানি, হস্তশিল্প, স্কিন কেয়ার, ফুড, হালাল কসমেটিকস ইত্যাদি বিশ্ববাজারে আরো জনপ্রিয় হতে পারে যদি সঠিক সময়ে ডিজিটাল মার্কেটিং ও লজিস্টিক্স ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা বাড়ানো যায়। আর এটা সম্ভব হলে বিশ্ববাজারে বিশাল রপ্তানি বাজার গড়ে ওঠা সম্ভব। গ্লোবাল বাংলাদেশ এর এই কনসেপ্ট গড়ার জন্য আমাদের কিছু অনুষঙ্গ প্রয়োজন। যেমন Cross-border e-commerce পলিসি
International storefront তৈরি। পেমেন্ট সিকিউরিটি ও শিপিং লজিস্টিক্স উন্নয়ন।
আমি মনে করি ই-কমার্স ইকোনমি কেবলমাত্র একটি বাণিজ্যিক কার্যক্রম নয়, এটি একটি সামাজিক-অর্থনৈতিক রূপান্তর আন্দোলন। এই খাতে নারীরা ঘরে বসে আয় করছেন, তরুণরা চাকরির পরিবর্তে ব্যবসায় নামছেন, গ্রামীণ উদ্যোক্তা শহরের ক্রেতার কাছে পণ্য পৌঁছাচ্ছেন—এগুলো এককভাবে কোনো অন্য খাতে দেখা যায় না। একটি ব্যবসা যদি রপ্তানির পথ খুলে দেয়, আয়-বৈষম্য কমায়, দক্ষতা ও প্রযুক্তি ব্যবহার বাড়ায় সেই সঙ্গে এতে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে, তাহলে তাকে আমি কেবল অর্থনীতি নয়, একটি জনআন্দোলনের অবয়ব হিসেবেই স্পষ্ঠভাবে দেখতে পাই। আমার এই বিশ্বাস থেকেই আমি ‘ই-কমার্স ইকোনমি’কে বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য এক আন্দোলনের রূপ দিতে চাই।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো তরুণ জনগোষ্ঠী। তাদের সম্ভাবনাকে ই-কমার্সের সঙ্গে যুক্ত করতে হলে চাই ব্যবহারিক শিক্ষা ও বাস্তব সহযোগিতা। এজন্য আমার বিস্তারিত কিছু পরিকল্পনা রয়েছে।
১) Skill-to-Seller Program – ফ্রিল্যান্সার, ডিজাইনার, কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের ই-কমার্স উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা।
২) Digital Founders Hub – স্টোর সেটআপ, পণ্য সোর্সিং, কনটেন্ট, ফটোগ্রাফি, মার্কেটিং—সব এক জায়গায় শেখার ব্যবস্থা।
৩) Startup Launchpad – তরুণদের জন্য মাসিক ইনকিউবেশন ওয়ার্কশপ, যেখানে সেরা আইডিয়াগুলো ইনভেস্টমেন্ট গাইডেন্সের উৎসাহ পাবে।
৪) Campus to Commerce – বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ‘ই-কমার্স ক্লাব’ গঠন ও প্রতিযোগিতা আয়োজন
আমার স্বপ্ন—তরুণদের হাত ধরে দেশ হবে ই-কমার্স ইকোনমি।
এই উদ্যোক্তা তৈরির প্রক্রিয়ায় নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। নারীরা হচ্ছেন ঘরে বসে ব্যবসার মাধ্যমে অর্থনীতিকে সচল করার সবচেয়ে সম্ভাবনাময় অংশীদার। তাদের সেই সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য আমার পাঁচটি প্রাথমিক পরিকল্পনা রয়েছে। এগুলোর সংক্ষিপ্ত রূপ শুধু এখানে দিচ্ছি। পরে কোনো এক সময় এই বিষয়ের বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিবো।
১) ঘরে বসে করা ব্যবসাকে স্বীকৃতিদানের নীতিমালা প্রণয়ন করা।
২) ট্রেড লাইসেন্স ছাড়াই Smart BDID-র মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন সুবিধা দেওয়া।
৩) নারীবান্ধব কুরিয়ার সেবা ও রিটার্ন সুবিধার কার্যক্রম শুরু করা।
৪) নারী উদ্যোক্তা বিশেষ ব্যাচ ও প্রচারণা চালানো।
৫)নারী উদ্যোক্তা উন্নয়ন তহবিল ও Soft Skill Training এর ব্যবস্থা করা।
আমার লক্ষ্য, নারী উদ্যোক্তাদের জন্য একটি সহজ, নিরাপদ ও সম্মানজনক ই-কমার্স ইকোসিস্টেম তৈরি করা।
আর একটা বিষয় মনে রাখতে হবে গ্রাহক আস্থা ফিরিয়ে আনা এখন ই-কমার্স খাতের সবচেয়ে জরুরি চ্যালেঞ্জ। এই সঙ্কট থেকে উত্তরণের জন্য আমি একটা রোডম্যাপ অনুযায়ী সামনে বাড়তে চাই। সেটা হতে পারে এমন-
১) Verified Seller Accreditation System
২) ডিজিটাল ডিসপিউট রেজোলিউশন বোর্ড (DRB) – যেখানে নিরপেক্ষ তদন্তে দ্রুত সমাধানের ব্যবস্থা করা।
৩) গ্রাহকের অভিযোগের সর্বোচ্চ ৩ দিনের মধ্যে সমাধান নীতিমালা প্রণয়ন করা।
৪) Smart Review & Rating System চালু করা। আর সেই রিভিউ হবে যাচাইযোগ্য ও নিরপেক্ষ এবং অবশ্যই আস্থাভাজন।
৫) Trust Score Index – প্রত্যেক বিক্রেতার উপর আস্থার মেট্রিক্স প্রকাশ করা।
এই পদক্ষেপগুলো থাকলে গ্রাহকের আস্থা ফেরানো সম্ভব, এবং ই-কমার্স হবে বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প।
ই-ক্যাবের নির্বাচন এবং নির্বাচন পরবর্তী পরিকল্পনাও আমি ইতোমধ্যে গ্রহণ করেছি। নির্বাচিত হলে আপনার প্রথম ১০০ দিনের অগ্রাধিকার কি হবে তার একটা খসড়া তালিকাও তৈরি আমার।
১) Smart BDID পাইলট চালু ও রেজিস্ট্রেশন ফ্রেমওয়ার্ক প্রস্তুত করা।
২) Trust & Compliance Cell গঠন – গ্রাহক ট্রাস্ট ও ট্রানজেকশন মনিটরিং সেল গঠন করা।
৩) e-CAB Dashboard তৈরি – সদস্য ডেটা, সমস্যার ধরণ ও সমাধান অগ্রগতি ট্র্যাকিং প্রস্তুত করা।
৪) সদস্যদের জন্য Helpline ও Monthly Townhall Meeting চালু করা।
৫) নারী উদ্যোক্তা ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য আলাদা সাপোর্ট ইউনিট গঠন করা।
৬) Cross-border E-commerce কর্মশালা ও রপ্তানি পরিকল্পনা ঘোষণা করা।
৭) ট্রেনিং ক্যালেন্ডার ও Knowledge Portal চালুর উদ্যোগ নেওয়া।
এই ১০০ দিন হবে একটি বাস্তবায়ন অভিযানের সূচনা।
ই-কমার্সের প্রকৃত প্রাণ হচ্ছে ক্ষুদ্র, নারী ও তরুণ উদ্যোক্তারা। তবে, বড় উদ্যোক্তাদের ই-ক্যাবে সংশ্লিষ্ট করতে কাজ করবো। যারা ফেসবুকে, ইনস্টাগ্রামে, নিজের ওয়েবসাইটে বা লোকাল মার্কেটপ্লেসে ব্যবসা করছেন—তাদের কথা আগে বলা দরকার। সবাইকে নিয়েই হবে e-CAB—এটাই আমার প্রতিশ্রুতি। সেই সঙ্গে রপ্তানিমুখী ই-কমার্স গড়াই হবে গ্লোবাল বাংলাদেশ গড়ার প্রধান ভিত্তি।
লেখক :
ড. মোহাম্মদ নূরুজ্জামান, গ্রুপ সিইও, ড্যাফোডিল ফ্যামিলি
চেয়ারম্যান, গ্রীন ডাটা লিঃ
প্রতিনিধি ISTQB & TMMi
ট্রেজারার, গ্লোবাল এন্টারপ্রেনিউরশিপ নেটওয়ার্ক-বাংলাদেশ
ভাইস প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ উশু ফেডারেশন
এডজাংক্ট ফ্যাকাল্টি, বিবিএস ইন ই-বিজনেস, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।