রোববার   ০৩ আগস্ট ২০২৫ , ১৯ শ্রাবণ ১৪৩২

সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ১১:২০, ২ আগস্ট ২০২৫

‘কাঙ্ক্ষিত’ পানি নেই হাওরে, প্রভাব পড়বে মাছ-কৃষিতে

‘কাঙ্ক্ষিত’ পানি নেই হাওরে, প্রভাব পড়বে মাছ-কৃষিতে

সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চলে পানি না থাকার কারণে কৃষি ও মৎস্য উভয় খাতে সংকট দেখা দিয়েছে। এতে মাছের আবাসস্থল নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি প্রজননও কমে যাচ্ছে। কৃষকরা সেচ সংকটে ভোগছেন। ফলে জমির ফসল উৎপাদন কমে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে হাওর অঞ্চলের মানুষের জীবন ও জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে।

সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার বলেন, “এবার বর্ষার পানির অভাবে হাওরের বাস্তুতন্ত্রে বিরাট প্রভাব পড়েছে।”

হাওরে একটি প্রবাদ রয়েছে- ‘বর্ষায় নাও, হেমন্তে পাও’, যা হাওর অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার একটি বাস্তব চিত্র তুলে ধরে। এর অর্থ বর্ষাকালে হাওরাঞ্চলে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম নৌকা, আর হেমন্তকালে পায়ে হেঁটে যাতায়াত করা যায়।

অর্থাৎ বর্ষায় হাওরের চারদিকে পানি থাকায় নৌকা ছাড়া চলাচল করা কঠিন। তবে হেমন্তকালে পানি নেমে গেলে রাস্তাঘাট আবার দৃশ্যমান হয়, তখন হেঁটে চলাচল করা যায়।

কিন্তু এবার বর্ষাকালে হাওরে পর্যাপ্ত পানি না হওয়ায় কমেছে এই প্রবাদের তাৎপর্য। পানির অভাবে স্বাভাবিক নৌ-যাতায়াত ব্যাহত হওয়ায় যোগাযোগ বিড়ম্বনায় পড়েছেন হাওরবাসী।

কৃষক ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন, উজানে ভারতীয় নদীগুলোতে পানি নিয়ন্ত্রণ, ব্যারাজ নির্মাণ, নদী দখল, অপরিকল্পিত বাঁধ ও নদ নদীর ড্রেজিং না হওয়া হাওরে পানি না থাকার ‘অন্যতম কারণ’।

এ জন্য প্রকৃতি ও পরিবেশের উপর চালানো আগ্রাসী তৎপরতা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন পরিবেশ ও হাওর সচেতন মানুষরা।

কৃষক ও জেলেদের হতাশা

হাওরপাড়ের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা পুরোদস্তুর কৃষি ও মৎস্য আহরণের ওপর নির্ভরশীল। এ দুটোই তাদের জীবন-জীবিকার উৎস। তবে এ বছর হাওর ও জলাশয়গুলোতে পানি কম থাকায় মাছের অপ্রতুলতার পাশাপাশি ফসলহানির শঙ্কাও দেখা দিয়েছে।

পানি কম থাকায় হাওর অঞ্চলের মাছের বাজারে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। অন্য বছর এই সময়ে হাওরের বাজার ভর্তি দেশীয় মাছের দেখা মিললেও এবার তুলনামূলক ‘কম’; দামও ‘আকাশচুম্বি’।

সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার গৌরারং ইউনিয়নের নোয়াগাঁও গ্রামের মৎস্যজীবী আলকাছ মিয়া বলেন, “হাওরে পানি কম থাকায় আগের মত মাছ ধরতে পারি না। হাওরের যেসব পয়েন্ট সাধারণ বর্ষায় জাল ফেলা হয় এখন সেসব পয়েন্টে পানির জন্য জাল ফেলতেও সমস্যা হচ্ছে। হাওরে এবার মাছ অনেক কম।”

সুনামগঞ্জ মাছ বাজারের বড় ব্যবসায়ী সোয়েব মিয়া বলেন, “অন্যান্য বছর এই সময়ে দেশি মাছে ভরা থাকে হাওর। এবার মাছের পরিমাণ গতবারের অর্ধেকও না। তাই বাজারে মাছের দামও বেড়েছে দ্বিগুণ। তারপরও দেশি মাছ মিলছে না। এবার মৎস্য আহরণের মৌসুমে জলমহালেও মাছ কম হবে।”

সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার বোগলাখাড়া গ্রামের কৃষক ওবায়দুর রহমান কুবাদ বলেন, “হাওরে যেভাবে পানি কমছে বোরো মৌসুমে ধান লাগানো কঠিন হয়ে পড়বে। বীজতলা তৈরি করতেও কষ্ট হবে। কষ্ট করে ধান লাগানো গেলেও সেচের জন্য পানি মিলবে না। এতে আমাদের একমাত্র বোরা ফসল উৎপাদন ঝুঁকির মুখে পড়বে।”

দিরাই উপজেলার বাসিন্দা ক্ষেতমজুর ও কৃষক নেতা অমরচাঁন দাস বলেন, “কার্তিক মাসে আল-জাঙ্গাল ভেসে ওঠা হাওরকে জীর্ণ-শীর্ণ দেখি। এখন সেই চিত্র দেখছি। হাওরে সহজ নৌ-যাতায়াত বিঘ্নিত হচ্ছে। মানুষজনের চলাচল করতে সমস্যা হচ্ছে।

“বর্ষাই হাওরের সৌন্দর্য্য। অথচ এখন এ মৌসুমে নৌকা চলে না। বাজারে মাছ মিলে না।”

পানির পরিসংখ্যানে সংকটের কথা

সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার জানান, গত বছরের ২৯ জুলাই সুনামগঞ্জ পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি ৬ দশমিক ৩৭ মিটার, ৩০ জুলাই ৬ দশমিক ৩৬ এবং ৩১ জুলাই ৬ দশমিক ৩০ মিটার উচ্চতায় প্রবাহিত হয়েছিল। এ বছর একইদিনে একই পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি ৫ দশমিক ৮৪, ৫ দশমিক ৮১ ও ৫ দশমিক ৮৩ মিটার উচ্চতায় প্রবাহিত হচ্ছে।

তিনি বলেন, “গত বর্ষা মৌসুমে সুরমা নদী, পুরাতন সুরমা নদী ও জাদুকাটা এই তিনটি নদীতে জুলাই মাসের বেশিরভাগ সময়ই পানি বিপৎসীমার উপরে ছিল। কিন্তু এবার উল্টো চিত্র লক্ষ্য করা গেছে।”

জলবায়ু পরিবর্তন ও মানবসৃষ্ট কারণ

পাউবোর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জলবায়ুর প্রভাবের কারণে চলতি মৌসুমে উজান ভাটিতে কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি হচ্ছে না। জুনে কিছুটা বৃষ্টিপাত হওয়ায় সামান্য পানি বেড়েছিল। এরপর আর পানি বাড়েনি। জুলাই মাস থেকে পানি কমছেই। এবার হাওরের রাস্তাঘাট, জাঙ্গাল এখনো ভেসে আছে। বিভিন্ন স্থানে জাঙ্গালে গবাদিপশু ঘাস খেতে দেখা যাচ্ছে।

হাওর অঞ্চলের বাসিন্দারা বলছেন, বর্ষায় পাহাড়ি ঢল নদনদী হয়ে বিভিন্ন খাল ও নদী হয়ে হাওরে প্রবেশ করে। এ ছাড়া বৃষ্টির পানিও ধারণ করে হাওর। এবার পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হওয়ায় এবং উজানের ঢল না হওয়ায় হাওরে পানি কম। জেলার প্রধান প্রবাহমান ধারা সুরমা নদীতেই পানি কম। অন্য নদ-নদীরও একই অবস্থা।

বর্ষার নয়া পানি হাওরে না নামলে মাছের প্রজনন, বিচরণ ও জলজ জীববৈচিত্রের খাদ্যে প্রভাব পড়বে। আগাম বন্যার মুখে পড়বে হাওর। হাওরের এমন প্রকৃতি সংস্কৃতি ও কৃষকদের জন্য ‘বিপদবার্তা’ বলছেন হাওরের প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশ-প্রতিবেশ বিশেষজ্ঞরা।

অ্যাসোসিয়েট ফর ইনোভেটিভ রিসার্স অ্যান্ড ডেভেলাপমেন্ট (এআইআরডি) পরিচালক ও গবেষক আব্দুল হাই চৌধুরী বলেন, “শ্রাবণ মাসে পানিশূন্য হাওর চিন্তাই করা যায় না। এটি শুধু এক মৌসুমী ব্যতিক্রম নয়, হাওরের জন্য গভীর পরিবেশগত সংকটের সংকেত।

“এর পেছনে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন, উজানে পানিপ্রবহ নিয়ন্ত্রণ, নদীর স্বাভাবিক গতিপথে বাধা, খাল-নদী-বিল ড্রেজিংয়ের ঘাটতি, অপরিকল্পিত ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণ।”

দ্রুতই উদ্যোগ না নিলে হাওরের জীববৈচিত্র্য ও জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে পড়বে এবং আগামীতে এ কারণে হাওরে মানবিক বিপর্যয় নেমে আসার আশঙ্কার কথাও জানান তিনি।

আব্দুল হাই বলেন, “এই অবস্থার জন্য একাধিক আন্তঃসম্পর্কীয় কারণ রয়েছে। আন্তঃদেশীয় পানি ব্যবস্থাপনায় কূটনৈতিক তৎপরতা, অভ্যন্তরীণ নদী ব্যবস্থাপনায় সংস্কার এবং জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামো সংস্কার জরুরি।”

হাওরের ঐতিহ্য হারাচ্ছে গতি

বর্ষায় কখনোই হাওরে উৎসব পালনে বৈচিত্র্য আসে না; যদি না ওই বছর বোরো ধানের ফলন ভালো হয়। হাওরের ৮০ শতাংশ মানুষ কৃষিজীবী। হাওরের কৃষিজমি এক ফসলি অর্থাৎ বোরো ধানভিত্তিক হওয়ায় বোরো ফসল ভালো না জন্মালে সারা বছর অভাব-অনটনে থাকতে হয়। বোরো ফলনের ওপরই নির্ভর করে এখানকার মানুষের আনন্দ-বেদনা-সুখ-দুঃখ। শুষ্ক মৌসুমের পাঁচ মাস এখানে কৃষকেরা হালচাষ করেন।

দিরাই উপজেলার বাসিন্দা উন্নয়ন কর্মী তরুণ কান্তি দাস বলেন, “হাওরে পানি না থাকায় এখন ক্ষেত ভেসে ওঠছে। গবাদিপশু ঘাস খাচ্ছে হাওরে। অথচ এমন দৃশ্য কার্তিক মাসের আগে আমরা কখনো দেখিনি। এবার হাওরে বর্ষাই আসেনি।”

পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য বিষয়ক গবেষক ও লেখক পাভেল পার্থ বলেন, ‘বর্ষায় নাও-হেমন্তে পাও’ প্রবাদের হাওর এখন বদলে যাচ্ছে। আষাঢ়-ভাদ্র ভরা বর্ষা থাকলেও এখন হাওরে পানি নেই। এটি হাওরের জন্য ভয়াবহ বিপদ বার্তা। বর্ষার নয়া পানি হাওরে না থাকলে মাছের প্রজনন, বংশবিস্তার ও বিচরণ বাধাগ্রস্ত হয়। জলজজীবের খাদ্য সংকট দেখা দেয়।

“মূলত ঋতুভিত্তিক এই পানিই হাওরের কৃষি উৎপাদন স্বাভাবিক রাখে। বর্ষায় পানি কম হলে হাওরে নিদান ও খড়া দেখা দেয় এবং জলাবন বেত, মুর্তা, হিজল, কড়চ, নল নটার জঙ্গল বাঁচতে পারে না।”

ঋতুভিত্তিক বর্ষার পানিই হাওরের কৃষিকে বাঁচিয়ে রাখে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “হাওরে জলচর পানির আবাস ও বিস্তার পানিতেই। পানিশুন্য হাওর কৃষি ও মৎস্য উৎপাদন, প্রকৃতি, বাস্তুতন্ত্র ও জীবন-জীবিকা ও সংস্কৃতিকেও প্রভাবিত করে।

“হাওরের ধামাইল, লোকগান, কিংবা যে কোনও সামাজিক ও ধর্মীয় কৃত্য পর্ব সব কিছুই ভাসান পানির উপর নির্ভরশীল। শ্রাবণী বা মনসা পূজায় হাওরের পানি না থাকাকে অলক্ষণ হিসেবে দেখা হয়। তাই হাওরে পানি না থাকলে বহুমুখি সংকট দেখা দেয় হাওরজীবনে।”

পানির অভাবে হাওরের বিপর্যয়

সুনামগঞ্জ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শামসুল করিম বলেন, “এবার হাওরে বর্ষাই আসেনি। বৃষ্টিপাত কম হয়েছে। এ কারণে নদীতে পানি নেই। নদীতে পানি কম হলে হাওরেও পানি কম থাকে। হাওরে বর্ষা বিলম্বিত হওয়ায় এবং পানি না থাকায় মাছের প্রজনন ও উৎপাদনে প্রভাব পড়ছে।

“এ বছর মাছ আহরণ মৌসুমে জলাশয়গুলোতে মাছ কম থাকবে। এই লক্ষণ এখনই বাজারগুলোতে দেখা গেছে। বাজারে মাছ কম এবং দামও বেশি।”

সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. ওমর ফারুক বলেন, “এ বছর হাওরে বৃষ্টিপাত কম হয়েছে। উজানের বৃষ্টিপাতের কাঙ্ক্ষিত পানিও নামেনি। তবে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, ঝড়ো বৃষ্টি হবে। বৃষ্টি হলে হাওরে পানি বাড়বে; যা আগামী বোরো মৌসুমের জন্য ভালো হবে।”

যদি পানি আর না বাড়ে তাহলে বোরো চাষাবাদ কিছুটা ব্যাহত হতে পারে। তবে বর্ষা না আসায় হাওরে পলিও কম পড়েছে বলে জানান তিনি।

সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার বলেন, “হাওরে পানি না থাকায় কৃষকরা আগামী বোরো ফসল নিয়ে চিন্তিত। এই অবস্থা থাকলে সেচ সংকট তৈরি হবে। টেম্পারাচারও বেশি থাকবে। যার ফলে ধানে চিটা বেশি হতে পারে।”

সর্বশেষ

জনপ্রিয়