শিক্ষা পুনর্গঠন:
বাংলাদেশের হারানো ২৮ মিলিয়ন শিক্ষার্থীর সন্ধান

বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে এমন এক সংকটপূর্ণ সময় অতিক্রম করছে, যখন শিক্ষা খাতে এক গভীর বিপর্যয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রতিবছর প্রায় ৩ কোটি শিক্ষার্থী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে মাত্র ২০ লাখ। অর্থাৎ প্রায় ২৮ মিলিয়ন শিক্ষার্থী শিক্ষা যাত্রার মাঝপথেই হারিয়ে যায়, যা নিঃসন্দেহে একটি জাতীয় সংকট। "স্মার্ট এবং প্রযুক্তি নির্ভর বাংলাদেশ" গঠনের স্বপ্ন বাস্তবায়নে এই বাস্তবতা বড় বাধা।
BANBEIS-এর তথ্য অনুযায়ী, এই ড্রপআউটের পেছনে রয়েছে স্কুল-টু-স্কুল ট্রানজিশনের দুর্বলতা, দারিদ্র্য, বাল্যবিবাহ, শিশুশ্রম, লিঙ্গ বৈষম্য এবং মানসম্পন্ন মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার অভাব—বিশেষ করে গ্রামীণ ও প্রান্তিক এলাকায়।
এই সংকট মোকাবেলায় প্রয়োজন সমন্বিত, তথ্যনির্ভর ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা সংস্কার। সর্বপ্রথম, সরকারকে হারিয়ে যাওয়া শিক্ষার্থীদের সনাক্ত করার জন্য জাতীয় কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। স্কুল ট্র্যাকিং সিস্টেম, স্থানীয় প্রশাসন ও এনজিওগুলোর সমন্বয়ে এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
সাথে থাকতে হবে শিক্ষকদের জন্য কঠোর মনিটরিং ব্যবস্থা এবং আকর্ষণীয় বেতন ও সুযোগ-সুবিধা, যাতে যোগ্য ও প্রতিশ্রুতিশীল তরুণরা এই পেশায় আগ্রহী হন। বর্তমানে একজন প্রাথমিক শিক্ষক মাত্র ১২,৫০০–১৮,০০০ টাকা বেতন পান, যা অনেককে নিরুৎসাহিত করে। তাই শিক্ষকদের শিশু মনোবিজ্ঞান, অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা, ডিজিটাল কৌশল ও নৈতিক শিক্ষায় প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা জরুরি।
বিদ্যালয়ে থাকতে হবে শিশু পরিচর্যা কেন্দ্র, আলাদা টয়লেট, বিশুদ্ধ পানি, খেলার মাঠ ও ক্রীড়া সুযোগ। শ্রেণিকক্ষে ব্যবহার করতে হবে ডিজিটাল কনটেন্ট, মাল্টিমিডিয়া শিক্ষা, STEM কিট ও হাতে-কলমে শেখার উপকরণ। গবেষণায় দেখা গেছে, মাল্টিমিডিয়া শিক্ষায় শিখন ধরে রাখার হার প্রায় ২৫% বেশি।
মধ্যাহ্নভোজ ও পুষ্টিকর খাবার চালু করলে দারিদ্র্যপীড়িত পরিবারের শিক্ষার্থীদের স্কুলে ধরে রাখা সহজ হবে। জামালপুর ও নেত্রকোনার কিছু পাইলট প্রকল্প ইতোমধ্যে সফল হয়েছে।
পাঠ্যক্রমে থাকতে হবে জীবনদক্ষতা, নৈতিকতা, পরিবেশ সচেতনতা, দুর্যোগ প্রস্তুতি ও ডিজিটাল সাক্ষরতা। শিক্ষকেরা যেন বন্ধুত্বপূর্ণ, সম্মানজনক ও উৎসাহদায়ক আচরণ করেন এবং অভিভাবকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করেন, তা নিশ্চিত করতে হবে। EMIS (Education Management Information System)-এর মতো প্রযুক্তিনির্ভর মূল্যায়ন ও মনিটরিং চালু করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীদের অগ্রগতি ও শিক্ষক কার্যকারিতা পরিমাপযোগ্য হয়। ড্রপআউট হলেই যেন স্থানীয় পর্যায়ে সতর্কবার্তা যায় এবং তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়, সেজন্য কমিউনিটি-ভিত্তিক অ্যালার্ট ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
এই মুহূর্তে আমাদের সিদ্ধান্ত ও করণীয় নির্ধারণ করবে আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ। শিক্ষাব্যবস্থাকে একটি শক্ত ভিতে দাঁড় করাতে না পারলে উন্নত ও মানবিক বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে। এখনই সময়, এই হারিয়ে যাওয়া ২৮ মিলিয়ন শিক্ষার্থীর খোঁজে জাতিকে জাগ্রত করা।
এ কে এম মাহফুজুর রহমান,
উপ-পরিচালক, ফ্যাকাল্টি এইচআর
(নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে কর্মরত)