সোমবার   ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪ , ২৪ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ০৮:৪৯, ৩০ অক্টোবর ২০২৪

চালের দাম বাড়ছেই: সবজি, ডিম, মাংসসহ সব নিত্যপণ্যের দামও চড়া

চালের দাম বাড়ছেই: সবজি, ডিম, মাংসসহ সব নিত্যপণ্যের দামও চড়া

বাজারে চালের দাম বাড়ছে।  উদ্বেগজনক খবর হলো, সাম্প্রতিক অতিবৃষ্টি ও ভারতসহ উজানের দেশগুলো থেকে আসা ঢলে আমনের আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উৎপাদনে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াতে পারে প্রায় ৮ লাখ ৩৯ হাজার টন।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি) সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে সরকারের কাছে দেওয়া একটি প্রতিবেদনে বলেছে, চাল আমদানি বাড়াতে শুল্ক-কর পুরোপুরি তুলে নেওয়া দরকার।

চাল সরকারের জন্য একটি সংবেদনশীল পণ্য। গরিব মানুষের খাদ্য ব্যয়ের একটি বড় অংশ যায় চালের পেছনে। চালের দাম এমন সময় বাড়ছে, যখন ভোজ্যতেল, চিনি, সবজি, ডিম, মুরগির মাংসসহ প্রায় সব নিত্যপণ্যের দাম চড়া।

আমন চাল উৎপাদনের দ্বিতীয় প্রধান মৌসুম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, বছরে দেশে চার কোটি টনের মতো চাল উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে দেড় কোটি টনের মতো হয় আমনে। সপ্তাহ তিনেক পর থেকে আমন চাল বাজারে আসা শুরু করতে পারে।

দেশে কোনো মৌসুমে উৎপাদন ব্যাহত হলে চালের বাজার অস্থির হয়ে ওঠে। ২০১৭ সালে হাওরে আগাম বন্যায় বোরো মৌসুমের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তখন এক সপ্তাহে প্রতি কেজি মোটা চালের দাম ৭ থেকে ৯ টাকা বেড়ে ৫০ টাকা ছাড়িয়ে যায়।

এদিকে খাদ্য অধিদপ্তরও বলছে, তাদের গুদামে এখন চালের মজুত ১০ লাখ টনের নিচে নেমেছে, যা গত ১৫ আগস্ট ছিল প্রায় সাড়ে ১৪ লাখ টন। সরকারিভাবে বিতরণ বাড়ানোয় মজুত কমছে। যে হারে চাল বরাদ্দের পরিকল্পনা রয়েছে, তাতে আগামী বছরের জুলাই নাগাদ প্রয়োজনের তুলনায় ১১ লাখ টন চালের ঘাটতি হতে পারে। নিরাপত্তা মজুত ও সম্ভাব্য ঘাটতি বিবেচনায় ১০ লাখ টন চাল আমদানি করা দরকার। বেসরকারি খাতকেও চাল আমদানি বাড়াতে উৎসাহ দেওয়া প্রয়োজন।

খাদ্য অধিদপ্তরের পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘বন্যার কারণে এবার চাল উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। চালের মজুত বৃদ্ধির বিষয়ে আগে থেকেই সতর্ক হওয়ার জন্য খাদ্য মন্ত্রণালয়কে আমরা চিঠি দিয়েছি। আশা করছি মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে উদ্যোগী হবে।’

চালের দাম এক মাসে বেড়েছে ২ শতাংশ

ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশকে (টিসিবি) উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এখন চালের দাম ৭ থেকে ১০ শতাংশ বেশি। এক মাসে বেড়েছে ২ শতাংশ পর্যন্ত।

টিসিবির হিসাবে, বাজারে এখন মোটা চালের কেজি ৫২ থেকে ৫৫ টাকা। মাঝারি চাল ৫৮-৬৩ টাকা। সরু চাল বিক্রি হচ্ছে ৭২ থেকে ৮০ টাকা কেজি। এক সপ্তাহে চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ২ থেকে ৮ টাকা। সরু চালের সর্বনিম্ন দর ৮ টাকা বেড়ে ৭২ টাকা হয়েছে বলে উল্লেখ করেছে টিসিবি।

টিসিবি আরও বলছে, গত ৮ আগস্ট নতুন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর মোটা চালের সর্বনিম্ন দাম কেজিতে ২ টাকা, মাঝারি চাল ৪ টাকা এবং সরু চালের দাম ১২ টাকা বেড়েছে।

ঢাকায় চালের দুটি বড় পাইকারি বিক্রয়কেন্দ্র বাবুবাজার-বাদামতলী ও মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানে চালের দাম বাড়তির দিকে। দুই বাজারের ব্যবসায়ীরা দুটি কারণের কথা বলেছেন: এক. ধানের দাম বেড়ে যাওয়ার কথা বলে মিলমালিকেরা চালের দাম বাড়াচ্ছেন। দুই. আমনে যে উৎপাদন কম হবে, সে খবর বাজারে আছে। এ কারণে দাম বাড়ছে।

বাদামতলীর শিল্পী রাইস এজেন্সির মালিক কাওসার রহমান বলেন, চালের সরবরাহ বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমদানির বিকল্প নেই।

বিশ্ববাজার পরিস্থিতি

ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে বিশ্ববাজারের একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে এক বছর আগের তুলনায় এখন চালের দাম ১১ শতাংশ কম। বিগত এক মাসে তা ৪ থেকে ৫ শতাংশ কমেছে। কিন্তু তারপরও আমদানি করতে গেলে খরচ অনেক পড়বে।

কমিশন বলছে, থাইল্যান্ডের চালের দাম পড়বে ৬৬ টাকা কেজি। এর সঙ্গে শুল্ক-কর ও অন্যান্য খরচ যোগ করলে দেশে দাম পড়বে ৯২ থেকে ৯৫ টাকা। ভারত থেকে আমদানি করতে গেলে প্রতি কেজির দাম পড়বে ৫৪ টাকা। এর সঙ্গে শুল্ক-কর ও অন্যান্য খরচ যোগ করে দাম পড়বে ৭৫ থেকে ৭৮ টাকা। ট্যারিফ কমিশনের মত হলো, এই দামে চাল আমদানি কঠিন। শুল্ক-কর তুলে নিতে হবে।

বিটিটিসির চেয়ারম্যান মইনুল খান বলেন, ‘চালের বাজার ঠিক রাখতে শুল্ক প্রত্যাহার করা এখন জরুরি। চাল নিয়ে করা আমাদের প্রতিবেদনে এমন পরামর্শ উঠে এসেছে।’

সরকার ২০ অক্টোবর এক দফায় চালের শুল্ক-কর সাড়ে ৬২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশে নামিয়েছে। তবে এরপরও আমদানির ঋণপত্র বাড়েনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, শুল্ক-কর কমানোর পর মাত্র ২৬ টন চাল আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে। ট্যারিফ কমিশন এখন বাকি শুল্ক-করও তুলে নেওয়ার সুপারিশ করেছে। তবে সুনির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য। কমিশনের প্রতিবেদনটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) পাঠানো হয়েছে।

এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান গতকাল মঙ্গলবার মুঠোফোনে বলেন, ‘খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। ফলে দাম ও সরবরাহব্যবস্থা ঠিক রাখতে চাল আমদানিতে শুল্ক কমানোর নীতি-পদক্ষেপ সম্প্রতি একবার নেওয়া হয়েছে, প্রয়োজনে আবার নেব। বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি, শিগগির কিছু হবে।’

মজুতের প্রতিবেদন ওয়েবসাইটে আপডেট হয় না দুই মাস থেকে

খাদ্য মন্ত্রণালয় ‘দৈনিক খাদ্যশস্য পরিস্থিতি’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদনে প্রতিদিনের দাম, মজুত, আমদানি ও বিশ্ববাজার পরিস্থিতি তুলে ধরত। আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ দিকে প্রতিবেদনটি প্রকাশ বন্ধ করে দেওয়া হয়। নতুন সরকার এলেও সেই প্রতিবেদন ওয়েবসাইটে দেওয়া শুরু হয়নি। তবে একটি পাক্ষিক প্রতিবেদন এখনো প্রকাশ করা হয়। তাতে হালনাগাদ চিত্র থাকে না। মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে থাকা সর্বশেষ প্রতিবেদনটি দুই মাস আগের।

খাদ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, তারা ১০ লাখ টন মজুতের সঙ্গে আমন মৌসুমে স্থানীয় বাজার থেকে কিনে ৫ লাখ টন যোগ করবে। আগামী বোরোতে কিনবে ৬ লাখ টন। সঙ্গে বিতরণও চলতে থাকবে। ফলে প্রয়োজনের তুলনায় সরকারের কাছে ১১ লাখ টন চালের ঘাটতি তৈরি হতে পারে। সংকটের সময় সরকারের গুদামে ১৫ লাখ টন চাল থাকলে মজুত নিরাপদ ধরা হয়।

খাদ্য অধিদপ্তর বলছে, বিপুল পরিমাণ চাল উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে আমদানি করা কঠিন। এ জন্য রপ্তানিকারক দেশের সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ‘জি টু জি’ ভিত্তিতে (সরকারের সঙ্গে সরকারের চুক্তি) চাল আমদানির বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে।

সরকার ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১২ লাখ টনের বেশি চাল আমদানি করেছিল। পরের বছর আমদানি হয় ১ হাজার টনের কম।

বাজারে সরবরাহ বাড়াতে হবে

বাজারে চালের দাম অনেক দিন ধরেই চড়া। টিসিবির হিসাবে, ২০২০ সালের জানুয়ারিতে মোটা চালের সর্বনিম্ন দর ছিল ৩০ টাকা কেজি। তখন উৎপাদন বেশি হয়েছিল বলে দাম কম ছিল। সেটা বাড়তে বাড়তে এখন ৫০ টাকা ছাড়িয়েছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চালের দাম কমাতে নানা চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার সফল হয়নি। তারা বরং সারের দাম ও ডিজেলের দাম কয়েক দফা বৃদ্ধি করে কৃষকের উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে।

২০০৭ ও ২০০৮ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে চালের ঘাটতি তৈরি হয়েছিল। তখন সরকার প্রতি টন ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ ডলার (বর্তমান দর ৫৫০ ডলারের আশপাশে) দাম দিতে চেয়েও যথেষ্ট চাল আমদানি করতে পারেনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, চাল খুবই সংবেদনশীল পণ্য। সরকার চাইলেও অনেক সময় হুট করে আমদানি সম্ভব হয় না। বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে ও কারসাজি ঠেকাতে সরবরাহ বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, সরকারের উচিত এখন দরিদ্র মানুষের জন্য ভর্তুকি মূল্যে ব্যাপকভাবে চাল সরবরাহের ব্যবস্থা করা। এ জন্য টাকার প্রয়োজন হলে অন্য খাতে খরচ কমাতে হবে।

চালসহ গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের চাহিদা ও উৎপাদনের সঠিক পরিসংখ্যানের ব্যবস্থা করার ওপর জোর দেন সেলিম রায়হান। তিনি আরও বলেন, আগামী বোরো মৌসুমে যাতে ধান আবাদ বেশি হয়, সে জন্য এখন থেকেই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়া দরকার।
 

সর্বশেষ

জনপ্রিয়