সোমবার   ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪ , ২৪ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

নিজস্ব প্রতিবেদক:

প্রকাশিত: ১১:০৯, ২৮ নভেম্বর ২০২৪

আপডেট: ১১:১১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪

ঋণের আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ফিরল কেন্দ্রীয় ব্যাংক: সময়মতো কিস্তি শোধ না হলেই মেয়াদোত্তীর্ণ

ঋণের আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ফিরল কেন্দ্রীয় ব্যাংক: সময়মতো কিস্তি শোধ না হলেই মেয়াদোত্তীর্ণ

খেলাপি ঋণের মেয়াদ গণনায় আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ফেরার ঘোষণা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ঋণ শ্রেণীকরণ ও সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণ বিষয়ে গতকাল মাস্টার সার্কুলার জারি করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কম দেখাতে কয়েক বছর ধরেই নীতিছাড় দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এক্ষেত্রে খেলাপির মেয়াদ গণনায়ও দেয়া হয়েছিল অস্বাভাবিক ছাড়। নীতিছাড়ের এ সুযোগের অপব্যবহার করে ঋণের নামে ব্যাংক খাত থেকে লাখ লাখ কোটি টাকা বের করে নিয়েছে অলিগার্করা। 

নতুন নীতিমালা অনুযায়ী, সব ধরনের ঋণ পরিশোধ বা সমন্বয়ের জন্য নির্ধারিত দিনের পরবর্তী দিন থেকেই তা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে গণ্য হবে। কোনো ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ বা ওভারডিউ হয়ে যাওয়ার তিন মাস পর থেকেই সেটি খেলাপি বলে গণ্য হবে। এক্ষেত্রে তিন থেকে ছয় মাস পর্যন্ত খেলাপি হওয়া ঋণের মান হবে ‘সাব স্ট্যান্ডার্ড’ বা নিম্নমান। মেয়াদোত্তীর্ণের সময় যদি ছয় থেকে ১২ মাস হয় তবে সেটির মান ‘ডাউটফুল’ বা সন্দেহজনক বলে গণ্য হবে। আর কোনো ঋণের কিস্তি ১২ মাসের বেশি অপরিশোধিত থাকলে সে ঋণের মান হবে ‘ব্যাড/লস’ বা ক্ষতিকর। ঋণ শ্রেণীকরণের নতুন এ নীতিমালা ২০২৫ সালের ১ এপ্রিল থেকে কার্যকর হবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, দফায় দফায় নীতি ছাড় দেয়ার কারণে বর্তমানে কিস্তি পরিশোধ না করা সত্ত্বেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ হিসেবে গণ্য হতে এক বছর পর্যন্ত সময় লেগে যায়। আর চূড়ান্ত খেলাপি বা ক্ষতিকর মানে খেলাপি হতে দুই বছরেরও বেশি সময় লাগছে। নীতিছাড়ের সুযোগে দেশের অনেক ব্যবসায়ীই ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করছেন না। আবার ব্যাংকগুলোও খেলাপিযোগ্য ঋণ নিয়মিত দেখিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। নতুন নীতি কার্যকর হলে দেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরো বেড়ে যাবে।

নীতিছাড় সত্ত্বেও গত ১৫ বছরে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ নজিরবিহীনভাবে বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা, যা ব্যাংক খাতের বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ১৭ শতাংশ। খেলাপি ঋণ কম দেখাতে গত দেড় দশকে ঋণ পুনঃতফসিল, ঋণ পুনর্গঠন ও ঋণ অবলোপনের নীতিও সহজ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব প্রক্রিয়া ব্যবহার করে আরো প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকার ঋণ নিয়মিত দেখানো কিংবা ব্যালান্সশিট থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। আর উচ্চ আদালতের স্থিতাবস্থা নিয়েও ঋণ নিয়মিত দেখানোর সুযোগ দেয়া হচ্ছে। এসব মিলিয়ে দেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬ লাখ কোটি টাকারও বেশি বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। যদিও ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের সময় ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা।

ঋণ শ্রেণীকরণের নতুন নীতিমালায় সঞ্চিতি বা প্রভিশন সংরক্ষণের হারও নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, কোনো ঋণ নিয়মিত থাকলে সেটির বিপরীতে ১ শতাংশ হারে সাধারণ সঞ্চিতি রাখতে হবে। আর ঋণের মান যদি স্পেশাল মেনশন অ্যাকাউন্ট বা এসএমএ হয়ে যায়, তাহলে সঞ্চিতির হার হবে ৫ শতাংশ। কোনো ঋণ নিম্নমানে শ্রেণীকৃত হলে ঋণ স্থিতির ২০ শতাংশ সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হবে। আর সন্দেহজনক হলে ৫০ ও মন্দ মানের খেলাপি হলে সঞ্চিতি সংরক্ষণের হার হবে ১০০ শতাংশ। ব্যাংকের পরিচালন আয় থেকে খেলাপি ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হয়। যে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ যত বেশি হয়, সে ব্যাংকের সঞ্চিতি সংরক্ষণের হারও তত বেশি।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, আর্থিক খাত সংস্কার কর্মসূচির আওতায় ১৯৮৯ সালে সর্বপ্রথম ঋণ শ্রেণীকরণ ও প্রভিশনিং নীতিমালা প্রবর্তন করা হয়। আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চা ও পন্থাগুলো সমন্বয়ের লক্ষ্যে ওই নীতিমালায় বিভিন্ন পরিবর্তন এনে ধাপে ধাপে ১৯৯৮ ও ২০০৬ সালে এ বিষয়ে মাস্টার সার্কুলার জারি হয়েছিল। সর্বশেষ ২০১২ সালে ঋণ শ্রেণীকরণ ও প্রভিশনিং নীতিমালায় উল্লেখযোগ্য পরিমার্জন করে বিআরপিডি মাস্টার সার্কুলার নং- ১৪/২০১২ জারি করা হয়। মাস্টার সার্কুলার জারির পর ওই নীতিমালায় সময় সময় বিভিন্ন পরিবর্তন হয়েছে।

নতুন করে মাস্টার সার্কুলার জারির প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, ঋণ শ্রেণীকরণ ও প্রভিশনিং নীতিমালা আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় ১২ বছর পর বিআরপিডি মাস্টার সার্কুলার নং-১৫ জারি করা হয়েছে। এ সার্কুলারের মাধ্যমে ব্যাসেল-থ্রি নীতিমালার আলোকে ঋণ শ্রেণীকরণ ও প্রভিশনিং বিষয়ক একীভূত নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বলা হয়, ক্রমবিকাশমান অর্থনীতির সহায়ক শক্তি হিসেবে একটি শক্তিশালী আর্থিক খাতের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। আর্থিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে শ্রেণীকৃত ঋণের হার কমানোর বিষয়ে যুগোপযোগী পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। ব্যাংক খাত সংস্কার করার জন্য এরই মধ্যে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ওই পদক্ষেপের অংশ হিসেবেই আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চার আলোকে নতুন নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এতে ব্যাংকের সম্পদের প্রকৃত গুণমান নিরূপণ করা সম্ভব হবে। নতুন নীতিমালা ২০২৫ সালের এপ্রিল থেকে কার্যকর হবে। এ কারণে ব্যাংকগুলো ওই নীতিমালা পরিপালনের ক্ষেত্রে প্রস্তুতি গ্রহণের পর্যাপ্ত সময় পাবে।

সর্বশেষ

জনপ্রিয়