ইসির জন্য সার্চ কমিটি গঠন, নির্বাচনমুখী যাত্রা শুরু
নির্বাচন কমিশন (ইসি) পুনর্গঠনের জন্য অনুসন্ধান বা সার্চ কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে দেশে নির্বাচনী অভিযাত্রা শুরু হয়ে গেছে।
সার্চ কমিটির প্রধান হতে পারেন আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী। আর সদস্য পদে থাকছেন হাইকোর্টের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান। আইন অনুযায়ী, প্রধান বিচারপতি সার্চ কমিটির জন্য আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি এবং হাইকোর্টের একজন জ্যেষ্ঠ বিচারপতিকে মনোনীত করবেন। এ ছাড়া সার্চ কমিটিতে পদাধিকারবলে সদস্য হবেন মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মো. নুরুল ইসলাম, সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান মোবাশ্বের মোনেম এবং রাষ্ট্রপতির মনোনীত একজন নারীসহ দুজন বিশিষ্ট নাগরিক। এ বিষয়ে পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিন্নাতুননেসা তাহমিদা বেগম এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক সি আর আবরারকে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে আলোচনা রয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার সকালে এই কমিটি গঠনের আগাম খবর জানিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের সরকারের নির্বাচনমুখী প্রক্রিয়া গ্রহণ করার যে কাজ, সেটা শুরু হয়ে গেছে। আপনারা বলতে পারেন নির্বাচনমুখী যাত্রা শুরু হয়ে গেছে।’
ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, আজ-কালের মধ্যে এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি হতে পারে।
‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন-২০২২’-এ বলা আছে, রাষ্ট্রপতি ছয় সদস্যের সমন্বয়ে একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করবেন। কমিটির সভাপতি হবেন প্রধান বিচারপতি মনোনীত আপিল বিভাগের একজন বিচারক। সদস্য হবেন প্রধান বিচারপতি মনোনীত হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারক, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন এবং রাষ্ট্রপতি মনোনীত একজন নারীসহ দুজন বিশিষ্ট নাগরিক।
অনুসন্ধান কমিটি সভার কার্যপদ্ধতি নির্ধারণ করবে। এ কমিটির কাজে সাচিবিক সহায়তা দেবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। অন্যূন তিন সদস্যের উপস্থিতিতে অনুসন্ধান কমিটির সভার কোরাম গঠিত হবে। কমিটির সভায় উপস্থিত সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ হবে এবং ভোটের সমতার ক্ষেত্রে সভায় সভাপতিত্বকারী সদস্যের দ্বিতীয় বা নির্ণায়ক ভোট প্রদানের ক্ষমতা থাকবে। কমিটি গঠনের ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে প্রতিটি পদের জন্য দুজনের নামের সুপারিশ করবে।
তার আগে কমিটি যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের নাম প্রস্তাবের জন্য রাজনৈতিক দল এবং পেশাজীবী সংগঠনের কাছ থেকে নাম আহ্বান করতে পারবে। এসব পদের জন্য যোগ্যতা হবে বাংলাদেশের নাগরিক, বয়স ন্যূনতম ৫০ বছর এবং কোনো গুরুত্বপূর্ণ সরকারি, বিচার বিভাগীয়, আধাসরকারি, বেসরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত পদে বা পেশায় অন্যূন ২০ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা। উপযুক্ত আদালত কর্তৃক অপ্রকৃতিস্থ ঘোষিত, দেউলিয়া ঘোষিত হওয়ার পর দায় থেকে অব্যাহতি লাভ না করা এবং কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন কিংবা কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা বা স্বীকার করে থাকলে তিনি অযোগ্য বিবেচিত হবেন।
গতকাল সচিবালয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের সঙ্গে বৈঠকের পর নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে সার্চ কমিটি গঠনের সংবাদ জানিয়ে ড. আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের বলেন, ‘সার্চ কমিটি হয়ে গেলে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে। নির্বাচন কমিশন গঠন করা হলে ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ শুরু হবে। আমি আগেও বলেছি, ভোটার তালিকা নিয়ে প্রচুর প্রশ্ন ছিল। গত নির্বাচন এমন ভুয়া নির্বাচন ছিল যে ভোটার তালিকা নিয়ে মানুষের মাথাব্যথা ছিল না। এবার অসাধারণ একটা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করব। ভোটার তালিকা হালনাগাদ করতে হবে। শুধু এতটুকু বলতে পারি, আমাদের নির্বাচনমুখী যাত্রা শুরু হয়ে গেছে।’
ইসি সচিবালয় নতুন নির্বাচন কমিশনের অপেক্ষায়
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলে দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গত ৫ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এর পর থেকে দেশে নির্বাচন কমিশন নেই। এ কারণে নির্বাচন কমিশনের প্রশাসনিক কিছু কাজ ব্যাহত হচ্ছে বলে জানান নির্বাচন কমিশন সচিব শফিউল আজিম।
তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করছি, সার্চ কমিটি গঠনের পর নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা খুব শিগগির নতুন নির্বাচন কমিশন পেতে যাচ্ছি। বর্তমানে নির্বাচন কমিশন না থাকায়, বিশেষ করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার না থাকায় প্রশাসনিক কিছু কাজ ব্যাহত হচ্ছে। ভোটার তালিকা আইন অনুসারে আগামী ২ জানুযারি থেকে ২ মার্চ পর্যন্ত ভোটার তালিকা হালনাগাদ করতে হবে। কমিশনের অনুমোদন ছাড়া সে কাজ শুরু হবে না। এ ছাড়া আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতিমূলক কাজ শুরু করার জন্যও নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের প্রয়োজন রয়েছে।’
গত ২৪ সেপ্টেম্বর বার্তা সংস্থা রয়টার্সের ওয়েবসাইটে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের একটি বিশেষ সাক্ষাৎকার প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ হয়। তাতে বলা হয়, গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সম্পন্ন করে ১৮ মাস বা দেড় বছরের মধ্যে নির্বাচনের লক্ষ্যে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারকে যেকোনো পরিস্থিতিতে পূর্ণ সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান।
এরপর গত ১৭ অক্টোবর চ্যানেল আইয়ের ‘আজকের পত্রিকা’ অনুষ্ঠানে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয়, আগামী বছরের মধ্যে নির্বাচন করাটা হয়তো সম্ভব হতে পারে। অনেক ফ্যাক্টর রয়েছে। এটা প্রাইমারি অ্যাজাম্পশন (প্রাথমিক অনুমান)।’
এই বক্তব্য পরদিনের সংবাদপত্রগুলোতে গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হলে তিনি তাঁর ফেসবুক পেজে লেখেন, ‘নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পলিসি ডিসিশন। এর সময় সরকারের প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে ঠিক হবে। তিনিই একমাত্র এটা ঘোষণার এখতিয়ার রাখেন।’
এরপর গত বৃহস্পতিবার বিকেলে বাংলা একাডেমিতে ‘গণতন্ত্রের অভিযাত্রা, আসন্ন চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক আলোচনাসভায় আসিফ নজরুল রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্দেশে বলেন, ‘১৬ বছর ধৈর্য রেখেছেন এখন ধৈর্যহারা হলে হবে না। আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর দিনের পর দিন ভরসা রেখেছি, কিন্তু তারা করেনি। হাজার হাজার মানুষ নিকৃষ্ট গণতন্ত্রের জন্য প্রাণ দেয়নি, উত্কৃষ্ট গণতন্ত্রের জন্য প্রাণ দিয়েছে। সে জন্য শুধু নির্বাচন দিলে হবে না; আমাদের সংস্কারও করতে হবে।’
তবে রাজনৈতিক দলগুলো দ্রুত নির্বাচনের পক্ষে। পতিত স্বৈরাচার সরকারের সুবিধাভোগীদের অপতৎপরতা, নানামুখী সংকট, ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে রাষ্ট্রপতির বিতর্কিত মন্তব্য এবং সে কারণে রাষ্ট্রপতির অপসারণ দাবিসংক্রান্ত পরিস্থিতি দলগুলোর মধ্যে দ্রুত নির্বাচনের তাগিদ বাড়িয়েছে বলে অনেকে মনে করছে। চাপ আসছে আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকেও।
এ বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলো দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচন করার চাপ দেবে—এটাই স্বাভাবিক। নির্বাচনের মাধ্যমেই আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফিরতে হবে। এ নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ নেই। নির্বাচনের ব্যবস্থা করেই বিদায় নিতে হবে আমাদের। তবে ভবিষ্যতে নির্বাচনের নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে যাতে কোনো প্রশ্ন না ওঠে সে ব্যবস্থাও করা দরকার।’
এদিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর থেকেই কবে নাগাদ নির্বাচন হবে তা জানতে উদগ্রীব রাজনৈতিক দলগুলো। দায়িত্ব গ্রহণের পর গত ২৫ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রথম ভাষণে নির্বাচনের রোডম্যাপ না থাকায় বিএনপিসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে। দলগুলোর পক্ষ থেকে এ বিষয়ে দ্রুত সংলাপের আহ্বানও জানানো হয়। এরপর গত ২৯ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বিএনপি নেতারা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সংস্কার এবং নির্বাচনের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ব্যাপকভিত্তিক সংলাপ শুরুর অনুরোধ জানান। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ৩১ আগস্টের বৈঠকে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরতে বিভিন্ন ধরনের সংস্কার ও নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আহ্বান জানায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোট। তবে এ জন্য সরকারকে কোনো সময় বেঁধে দেওয়া হয়নি বলেও দলগুলোর পক্ষ থেকে জানানো হয়। গত ৫ অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপে দ্রুত রাষ্ট্র সংস্কার, নির্বাচন কমিশন গঠন এবং নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করতে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে প্রস্তাব দেয় বিএনপিসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল। প্রধান উপদেষ্টাও রাজনৈতিক দলগুলোকে জানান, নির্বাচন অন্তর্বর্তী সরকারের ১ নম্বর অগ্রাধিকার।
ওই দিন সংলাপ শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা বলেছি, নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন স্থগিত করে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে অনতিবিলম্বে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। নির্বাচন কবে হবে, সে বিষয়ে রোডম্যাপ দিতে।’
জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে বলা হয়, ‘আমরা দুটি বিষয় চেয়েছি, একটি রোডম্যাপ হবে সংস্কারের, আরেকটি নির্বাচনের। সংস্কার সফল হলে নির্বাচন সফল হবে।’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘সব সংস্কারের দায়িত্ব এই সরকারের নয়। গুরুত্ব দিতে হবে নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কারকে। রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে সংস্কার সম্পন্ন করে নির্বাচন কবে হবে, সেটার রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে।’
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের সম্মান সফল নির্বাচনের ওপর নির্ভর করছে। প্রধান উপদেষ্টাকে আমরা বলেছি যত দূর পর্যন্ত জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে সংস্কার সম্ভব, তত দূর পর্যন্ত সংস্কার করতে হবে। বাকি যেসব সংস্কার দরকার, তা পরের নির্বাচিত সরকার এসে করবে।’