শনিবার   ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ , ২৬ মাঘ ১৪৩১

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ০৯:২৭, ১২ জানুয়ারি ২০২৫

আপডেট: ০৯:৩১, ১৩ জানুয়ারি ২০২৫

বাড়তি কর, পকেট থেকে চলে যাবে ১২ হাজার কোটি টাকা

বাড়তি কর, পকেট থেকে চলে যাবে ১২ হাজার কোটি টাকা

বাংলাদেশে ডেঙ্গু ও সাধারণ জ্বরের রোগীর পথ্য হিসেবে বাড়তি চাহিদা থাকে মাল্টার। সরকার অবশ্য মাল্টা আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক ১০ শতাংশ বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করেছে। এতে মাল্টা আমদানিতে খরচ বাড়বে কেজিতে ১৫ টাকা। মোট শুল্ক–কর দাঁড়াবে কেজিতে ১১৬ টাকা। বাজারে মাল্টার দাম চড়া, কেজি ২৫০ থেকে ২৮০ টাকা।

মাল্টার মতো বিভিন্ন ফল, রান্নার গ্যাস, মুঠোফোনে কথা বলা ও ইন্টারনেট ব্যবহার, রেস্তোরাঁয় খাবার, বিস্কুট, টিস্যু, ঢেউটিন, রংসহ শতাধিক পণ্য ও সেবায় শুল্ক–কর বাড়িয়েছে সরকার। গত বৃহস্পতিবার মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট) ও সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। নতুন হার ইতিমধ্যে কার্যকর হয়েছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) দুজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শুল্ক–কর বাড়ানোর কারণে বছরে ১২ হাজার কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব আদায় করা যাবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। এতে সরকারের রাজস্ব ঘাটতি কমবে।

মানে হলো এই ১২ হাজার কোটি টাকা মানুষের পকেট থেকে যাবে। যদিও ৫ জানুয়ারি এনবিআর এক বিবৃতিতে দাবি করেছে, নতুন করে যেসব পণ্য ও সেবার শুল্ক–কর বাড়ানো হয়েছে, সেখানে নিত্যপণ্য নেই। এতে সর্বসাধারণের ভোগ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাবে না; মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব পড়বে না।

যদিও অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, ফল, মুঠোফোন সেবা, ইন্টারনেট, টিস্যু, রান্নার গ্যাস, পোশাক, রেস্তোরাঁয় খাবার ইত্যাদি এখন জীবনযাত্রার অনুষঙ্গ। নতুন করে শুল্ক–কর বৃদ্ধি মধ্যম ও নিম্নমধ্যম আয়ের মানুষের জীবনযাত্রায় চাপ বাড়াবে। এ ছাড়া অনেক পণ্য ও সেবায় আগে থেকেই উচ্চ হারে শুল্ক–কর রয়েছে। সেগুলোর ওপর কর বাড়ানোর যৌক্তিকতা নেই।

যেমন আপেল, মাল্টা ও কমলার মতো আমদানি করা ফলের ওপর ২০২২ সালে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপ করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। এখন বেশির ভাগ ফলে মোট করভার ১৩৬ শতাংশ। উচ্চ করের কারণে ফলের দামও চড়া। বাজারে এক কেজি আপেল ৩০০-৩৪০, মাঝারি ও বড় কমলা ২৬০-৩২০ এবং সবুজ আঙুর ৪৫০-৪৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। বাজার বিশ্লেষকেরা মনে করেন, বিদেশি ফলের চড়া দামের কারণে দেশি ফলে বিক্রেতারাও বাড়তি মূল্য আদায়ের সুযোগ পান।

বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইম্পোটার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, রোগীর পথ্য এবং স্বাস্থ্যকর খাবার হিসেবে বিদেশি ফল একসময় গরিব-ধনী সবাই খেতে পারত। তবে শুল্ক–কর বাড়িয়ে বিদেশি ফল এখন ধনীদের খাবারে পরিণত করা হয়েছে।

পণ্যের ওপর কর আদায় করা হয় শতাংশ হারে। ফলে কর কত হবে তা নির্ভর করে পণ্যের দাম, প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট রেয়াত নেওয়ার সক্ষমতা, উপকরণের মূল্য ইত্যাদি বিষয়ের ওপর। আমদানি করা পণ্যে মার্কিন ডলারের দাম কত ধরে শুল্কায়ন করা হয়, শুল্কায়ন মূল্য কত ধরা হয়, তার ওপরও করের পরিমাণ নির্ভর করে।

অবশ্য কাস্টমসের কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট খাতের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে মোটাদাগে শুল্ক–করের একটি ধারণা পাওয়া যায়। সাম্প্রতিক মূল্য ধরে দেখা যায়, এক কেজি আপেল, মাল্টা ও কমলার ওপর মোট করভার ১৫ টাকা বেড়ে ১১৬ টাকা, ১২ কেজির একটি তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) করভার ৭ টাকা বেড়ে ১০২ টাকা, বাজারে বিক্রি হওয়া ৬৫ থেকে ৭০ টাকা দামের এক প্যাকেট ফেসিয়াল টিস্যুর করভার ৪ টাকার মতো বেড়ে ৭-৮ টাকা এবং ১ হাজার টাকার পোশাক ও রেস্তোরাঁর খাবারে করভার ৭৫ টাকা বেড়ে ১৫০ টাকা দাঁড়িয়েছে।

মুঠোফোনে ১০০ টাকা রিচার্জ করে কথা বললে এবং ইন্টারনেট ব্যবহার করলে সরকার এখন দুই টাকা বেশি নিচ্ছে। মোট নিচ্ছে প্রায় ৩০ টাকা। বাসায় যাঁরা ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, তাঁদের ৫০০ টাকা বিলের ওপর মোট করভার সাড়ে ৭৭ টাকা দাঁড়িয়েছে, আগে যা ছিল ২৫ টাকা। ইন্টারনেট সেবাদাতারা অনেক ক্ষেত্রে আগের ভ্যাট বাবদ ২৫ টাকা আদায় করতেন না। তাঁরা বলছেন, যেহেতু ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপিত হয়েছে, সেহেতু এখন ভ্যাটসহ সম্পূরক শুল্ক আদায় করা ছাড়া উপায় থাকবে না।

দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি বিস্কুট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তাঁদের একটি জনপ্রিয় টোস্ট বিস্কুটের ২৫০ গ্রামের প্যাকেটের দাম ৬০ টাকা। এর মধ্যে ৫ শতাংশ হারে (উপকরণের মূল্যে) ৪ টাকা ২০ পয়সা ভ্যাট রয়েছে। ভ্যাট হওয়ার কথা ৩ টাকা। কিন্তু আগে ৫ শতাংশ ভ্যাটে রেয়াত নেওয়া যেত না। ফলে ৪ টাকা ২০ পয়সা দিতে হতো। নতুন হার ১৫ শতাংশ হওয়ায় এখন রেয়াত নেওয়া যাবে। তবে মোট ভ্যাট দাঁড়াবে ৯ টাকা।

এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ভ্যাট বাড়ানোর কারণে শিগগিরই দাম বাড়ানো হবে। তবে তা শুধু ভ্যাটের খরচে সীমিত থাকবে না। গ্যাসের দাম বাড়ার আশঙ্কা আছে। সব মিলিয়ে ৬০ টাকার বিস্কুট ৭০ টাকা নির্ধারণ করা হতে পারে।

ঢাকার একটি জনপ্রিয় সিনেমা হলে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ৩০০ টাকার টিকিটে এত দিন ভ্যাট আসত ৩০ টাকা। এখন আসবে ৪৫ টাকা। তারা ভ্যাট হিসাব করেই টিকিটের দাম নির্ধারণ করে। নির্ধারণের ক্ষেত্রে এমন একটি অঙ্ক ধরা হতে পারে যে ভাংতি টাকা নিয়ে ঝামেলায় পড়তে না হয়। এতে ভ্যাটের বাড়তি খরচের চেয়েও টিকিটের দাম কিছুটা বেশি পড়তে পারে।

শিল্প খাতেও এখন এলপিজি ব্যবহার করা হয়। এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (লোয়াব) জানায়, ভ্যাট বাড়ানোয় শিল্পে ব্যবহৃত ১২ কেজির সিলিন্ডারে খরচ বাড়বে প্রায় ৪৩ টাকা। সংগঠনটির সভাপতি আমিরুল হক বলেন, অধ্যাদেশ জারির পর বৃহস্পতিবার থেকে এই খরচ বেড়েছে। তবে এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। কারণ, এলপি গ্যাসের দাম নির্ধারণ করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। খরচ বাড়ার বিষয়টি সমন্বয়ের জন্য তারা কমিশনে যাবে।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাড়তি কর আদায় শুরু হয়েছে। গতকাল শনিবার ঢাকা ও চট্টগ্রামের কয়েকটি রেস্তোরাঁ ঘুরে দেখা যায়, সেখানে এখন খাবারের মোট দামের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আদায় করা হচ্ছে। চট্টগ্রামের আগ্রাবাদের অ্যামব্রোশিয়া রেস্টুরেন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মামুন উর রহমান বলেন, আগে কেউ ১ হাজার টাকার খাবার খেলে ৫০ টাকা ভ্যাট আসত। এখন আসছে ১৫০ টাকা।

নির্মাণ খাতের কয়েকটি পণ্য ও পণ্য তৈরির উপকরণের ওপর বাড়তি শুল্ক–কর বসেছে। বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো এইচআর (হট রোলড) কয়েল থেকে ঢেউটিন তৈরি করে। তারা আগে ৫ শতাংশ ভ্যাট দিত। এখন দিতে হবে ১৫ শতাংশ। ইস্পাতের পাত ও ঢেউটিন উৎপাদনকারী চট্টগ্রামের ‘পিএইচপি ফ্যামিলি’র পরিচালক মোহাম্মদ আমির হোসে বলেন, এমনিতেই ইস্পাত শিল্পে মন্দা রয়েছে। বিক্রি কমেছে। এ অবস্থায় নতুন করে ভ্যাট বাড়ানোর কারণে বিক্রি আরও কমে যেতে পারে।

শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত রং-বার্নিশে খরচও বাড়ছে। এর একটি উপাদান হলো হোয়াইট কোটিং পলি। এই পণ্য আমদানিতে কেজিপ্রতি শুল্ক–কর দিতে হতো ৩৮২ টাকা। নতুন করে সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর কারণে কেজিপ্রতি দিতে হবে ৪৪৯ টাকা। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের রঙের ছোট-বড় ক্যান, আইসক্রিমের বক্স, মবিলের ক্যান ও ওষুধের বোতল প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান গাজীপুরের টঙ্গীর এক্সক্লুসিভ ক্যানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসির বলেন, এমনিতেই উৎপাদন খরচ বাড়ছে। এখন নতুন করে রঙের খরচ বাড়ায় ক্যান তৈরির খরচও বাড়বে।

রাজধানীর বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সে গতকাল সন্ধ্যায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে কয়েকটি বড় ব্র্যান্ডের পোশাকের দোকানে নতুন হারে (১৫ শতাংশ) ভ্যাট নেওয়া হচ্ছে। বাকিরা আগের হারেই (সাড়ে ৭ শতাংশ) ভ্যাট নিচ্ছেন। নতুন হারে ভ্যাট আদায় নিয়ে ক্রেতার সঙ্গে বচসা হতেও দেখা গেল একটি দোকানে।

ওই দোকানে পোশাক কিনতে যান রাফাত আহমেদ নামের একজন বেসরকারি চাকরিজীবী। তিনি বলেন, তিনি একটি শার্ট কিনেছেন। দাম দিতে গেলে দেখেন ভ্যাট ধরা হয়েছে ১৫ শতাংশ, শার্টের ‘প্রাইস ট্যাগে’ লেখা ভ্যাটসহ মূল্যের চেয়ে বেশি। তিনি বলেন, একটি শার্টের দাম একঝটকায় ১৫০ টাকা বেশি নেওয়া হলো।

অন্যদিকে ওই দোকানের ব্যবস্থাপক বলেন, ভ্যাট যেদিন থেকে বসে, সেদিন থেকেই আদায় করতে হয়। তাঁরা এখনো ‘প্রাইস ট্যাগ’ নতুন করে লাগাতে পারেননি। তবে বিক্রয়কেন্দ্রে সরকারি প্রজ্ঞাপন প্রদর্শন করা হচ্ছে।

আলমাস সুপারশপ বসুন্ধরা সিটি শাখার ব্যবস্থাপক আরিফুর রহমান বলেন, বাড়তি ভ্যাট দেখে অনেক ক্রেতা বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন।

সর্বশেষ

জনপ্রিয়