গ্লোবাল সাউথের ‘বিগ বস’ কে? চীন…নাকি অন্য কেউ?
'দ্য গ্লোবাল সাউথ' শব্দবন্ধে আপত্তি আছে অনেকেরই। তাদের আপত্তির কারণ অনেকটা স্পষ্ট: মাত্র তিনটি শব্দে মরক্কো থেকে মালয়েশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ১০০-র বেশি দেশকে নিয়ে গঠিত এ গ্রুপের জটিলতা তুলে ধরা অসম্ভব। তবে জো বাইডেন, ইমানুয়েল মাখোঁ ও শি জিনপিং শব্দবন্ধটি লুফে নিয়েছেন।
সহজ কথায়, গ্লোবাল সাউথ বলতে অধিকাংশ অ-পশ্চিমা দেশগুলোকে বোঝানো হয়। বৈশ্বিক সম্পর্কের ওপর উদীয়মান অর্থনীতিগুলোর আরও ক্ষমতা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা এবং অধিকাংশ পশ্চিমা নীতির সমালোচনাও গ্লোবাল সাউথকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করে। গ্লোবাল সাউথ গাজা যুদ্ধ নিয়ে ক্ষুব্ধ; পশ্চিমাদের ইউক্রেন, কোভিড-১৯ ও জলবায়ুনীতি-সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নাখোশ।
মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক কুইন্সি ইন্সটিটিউট ফর রেসপন্সিবল স্টেটক্রাফট-এর সারাং শিদোরে বলেন, গ্লোবাল সাউথ এখনও নিবিড়ভাবে সঙ্ঘবদ্ধ নয়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, গ্লোবাল সাউথের অস্তিত্ব যদি আসলেই থাকে, তাহলে এর নেতৃত্বে আছে কে? নরেন্দ্র মোদি ইঙ্গিত দিয়েছেন, ভারত হতে পারে 'গ্লোবাল সাউথের কণ্ঠ'। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা ডা সিলভা বলছেন, তার দেশও দিতে পারে গ্লোবাল সাউথের নেতৃত্ব।
এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য দ্য ইকোনমিস্ট বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে মিলে বাণিজ্য, আর্থিক ও কূটনৈতিক সম্পর্কের তথ্য বিশ্লেষণ করেছে। সমস্ত তথ্য বিশ্লেষণের পর দি ইকোনমিস্টের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, গ্লোবাল সাউথের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবই এখনও সবচেয়ে বেশি, তবে এ গ্রুপের সদস্যদের মধ্যে চীন সবচেয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। ফলে গ্লোবাল সাউথের নেতৃত্বের সবচেয়ে শক্ত দাবিদার হয়ে উঠেছেন শি জিনপিং। একমাত্র সমস্যা হচ্ছে, চীনের নেতৃত্বের কিছু প্রতিবন্ধকতা আছে। এছাড়া অন্যান্য উদীয়মান শক্তিও রয়েছে।
ইউনিভার্সিটি অভ ডেনভারের পার্ডি সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল ফিউচারস (পিসিআইএফ) ১৯৬০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ক্ষমতার অবস্থার একটি সূচক তৈরি করেছে। সূচকের প্রধান মেট্রিক্সের নাম 'আনুষ্ঠানিক দ্বিপাক্ষিক প্রভাবের সক্ষমতা'। এর মাধ্যমে 'ক' দেশ 'খ' দেশের ওপর কতটা প্রভাব খাটাতে পারে, তা পরিমাপ করা হয়। এ পরিমাপটি করা হয় দুটি মাত্রার ভিত্তিতে। প্রথমটি 'ব্যান্ডউইথ'—সামনে-পেছনে কতটা সংযোগ আছে: বাণিজ্যের পরিমাণ, কূটনৈতিক প্রতিনিধিত্ব ইত্যাদি। দ্বিতীয়টি 'নির্ভরশীলতা'—'খ' দেশ অস্ত্র, ঋণ, বিনিয়োগ ইত্যাদির জন্য 'ক' দেশের ওপর কতটা নির্ভরশীল। সংযোগ বেশি থাকার অর্থ, 'ক' দেশ প্রভাব খাটানোর সুযোগ পাবে বেশি—আর বেশি ক্ষমতা থাকলে প্রভাব খাটানোটাও সহজ হয়। উদাহরণস্বরূপ, পাকিস্তানের ওপর চীনের প্রভাবের কথা ধরা যাক। দেশ দুটির দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে চীনের ক্ষমতা ও সংযোগ দুটোই বেশি। পিসিআইএফের সূচকে গ্লোবাল সাউথের ১৩০ বা ততোধিক দেশের মধ্যে ক্ষমতার সম্পর্ক খতিয়ে দেখা হয়েছে। উল্লেখ্য, গ্লোবাল সাউথের দেশগুলো জাতিসংঘভুক্ত জি৭৭-এর সদস্য।
১৯৭০-এর দশক থেকে জি৭৭-এর ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করা দেশটির নাম যুক্তরাষ্ট্র। সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তি ব্রিটেন ও ফ্রান্সের প্রভাবে ক্ষয় ধরলেও যুক্তরাষ্ট্রের 'প্রভাবিত করার সক্ষমতা' কমবেশি একই রয়ে গেছে। তবে বেইজিং ক্রমেই ওয়াশিংটনের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে। ২০০০ সালের দিক থেকে চীনের প্রভাব বাড়তে শুরু করে। সূচক অনুসারে, জি৭৭-এর ওপর চীনের প্রভাব তৃতীয় প্রভাবশালী দেশ ফ্রান্সের দ্বিগুণ, এবং ব্রিটেন, ভারত ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রায় তিনগুণ।
৩১টি দেশের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব খাটায় চীন। পাকিস্তান, বাংলাদেশ, রাশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব রয়েছে বেইজিংয়ের। বিপরীতে গ্লোবাল সাউথের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর দেশ ভারত জি৭৭-এর মাত্র ছয়টি সদস্যদেশের ওপর প্রভাব খাটাতে পারে। পিসিআইএফের আগের এক বিশ্লেষণ অনুসারে, ১৯৯২ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে চীনের প্রভাব বেশি এমন দেশের সংখ্যা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ৩৩ থেকে ৬১টিতে পৌঁছেছে। আমেরিকা মহাদেশে এখনও যুক্তরাষ্ট্রই সবচেয়ে প্রভাবশালী রাষ্ট্র। তবে চীন তার প্রভাববলয় আফ্রিকা ও এশিয়ায় বিস্তৃত করেছে।
সবকিছুর বাজার
সাম্প্রতিক সময়ে গ্লোবাল সাউথ নিয়ে ব্যাপক আগ্রহী হয়ে উঠেছে চীন। শি জিনপিং ও সিনিয়র চীনা নেতারা চীনকে 'গ্লোবাল সাউথের' অংশ বলতে শুরু করেছেন গত বছর থেকে। অথচ এর আগে এ কথায় তাদের ঘোর আপত্তি ছিল। ১৯৬০-এর দশকে একজন বামপন্থি মার্কিন একাডেমিক গ্লোবাল সাউথ শব্দযুগলের প্রবর্তন করেন। অর্থের বদল ঘটিয়ে এ শব্দবন্ধকে পশ্চিমবিরোধী ও চীনা-নেতৃত্বাধীন রূপ দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। গত সেপ্টেম্বরে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান, নিয়ম ও আইন বদলানোর প্রস্তাব প্রকাশ করে চীন। বেইজিং দাবি করে, এটি 'প্রকৃত বহুপাক্ষিক'-এর চিত্র—যার অর্থ, এসব নিয়মকানুনে পশ্চিমা দুনিয়া নাক গলাবে না। গত বছর চীনের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করেন, বিশ্বে মূল দ্বন্দ্ব বাইডেনের বলা গণতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের মধ্যে নয়, মূল দ্বন্দ্ব আসলে 'উন্নতি ও উন্নতি নিয়ন্ত্রণ, এবং বৈশ্বিক ন্যায়বিচার ও ক্ষমতার রাজনীতির মধ্যে'।
নিজের প্রভাব বিস্তারে চীন অত্যন্ত সুকৌশলে কাজ করছে। দোদুল্যমান রাষ্ট্রগুলোকে অবকাঠামো নির্মাণে সহায়তা, আর্থিক সহায়তাসহ আরও নানা সহায়তা দিয়ে টার্গেট করছে বেইজিং। ২০০০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১৬৫টি দেশে ১.৩১ ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয়ের ২০ হাজারের বেশি অবকাঠামো প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে চীন। এর মধ্যে অনেকগুলো প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে 'বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ'-এর (বিআরআই) আওতায়। কিছু বিশ্লেষকের তথ্য বলছে, এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংক অভ চায়নার মতো বৃহৎ রাষ্ট্রায়ত্ত ঋণদাতাদের কাছ থেকে ঋণ আসা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তবে গত নভেম্বরে এইডডাটার প্রকাশিত একটি নিবন্ধ বলছে উল্টো কথা। নিবন্ধটির অন্যতম লেখক ব্র্যাডলি পার্কস বলেন, 'বেইজিং পিছিয়ে আসছে না।' ওই নিবন্ধে দেখানো হয়েছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আরও অনেক প্রতিষ্ঠান ঋণ নিয়ে এগিয়ে আসছে। ২০২১ সালে চীন ৮০ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে। '[চীন] এখনও সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন অর্থায়নে একক বৃহত্তম অর্থায়নকারী।'
ভূরাজনৈতিক ইস্যুতে যারা কোনো পক্ষ নেয় না, তাদেরকে টার্গেট করছে চীন। এইডডাটা স্বীকার করেছে, বেইজিংয়ের অর্থায়নের দুই-তৃতীয়াংশ যায় 'দোদুল্যমান' দেশগুলোতে। এসব দেশে চীন বা যুক্তরাষ্ট্র কোনো দেশেরই স্পষ্ট প্রভাব নেই। এইডডাটা গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় তুলে ধরেছে। কোনো রাষ্ট্র যদি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে চীনের পক্ষে ১০ শতাংশ ভোট দেয়, তাহলে দেশটিতে বেইজিংয়ের অর্থায়ন ২৭৬ শতাংশ বাড়তে পারে। জিনজিয়াংয়ে ক্ষমতার অপব্যবহারের মতো ইস্যুতেও সমর্থন জোগাড়ের জন্য প্রভাব বিস্তার করেছে চীন। ২০০০ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে পররাষ্ট্রনীতি-সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের ভোটাভুটিতে চীন ৭৫ শতাংশ সময়ই 'নিম্ন ও মধ্য-আয়ের দেশগুলোর' ভোট পেয়েছে। গত বছর ব্রিকস সম্মেলনেও চীনের ক্ষমতার ঝলক দেখা গেছে। ওই সম্মেলনে বেইজিং সফলভাবে নিজের পছন্দের পাঁচটি দেশকে নতুন সদস্য হিসেবে ব্রিকসে অন্তর্ভুক্ত করতে পেরেছে।
চীন অন্যান্য অস্ত্রও ব্যবহার করে। ১২০টির বেশি দেশের প্রধান বাণিজ্য অংশীদার বেইজিং। চীন মূলত ২০১৬ সাল থেকে আইএমএফের মতো জরুরি সহায়তা হিসেবে ২৪০ বিলিয়ন ডলার অর্থায়ন করেছে বিভিন্ন দেশকে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অভিজাতদের সন্তুষ্ট করে অবকাঠামো প্রকল্পও দ্রুত বাস্তবায়ন করছে দেশটি। গত পাঁচ বছরে সাব-সাহারান আফ্রিকায় রাশিয়াকে টপকে প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী হয়ে উঠেছে বেইজিং।
নেতৃত্ব দখলের দৌড়ে কে এগিয়ে, কে পিছিয়ে
জি৭৭-এ চীনের নেতৃত্ব শ্রদ্ধাজাগানিয়া হলেও দেশটি বেশ কিছু সমস্যাতেও আছে। প্রথম সমস্যা হচ্ছে, চীনের প্রভাবের সীমা ও তীব্রতা দুটোই সীমিত। লাতিন আমেরিকায় দেশটি এখনও নেতৃস্থানীয় অবস্থান অর্জন করতে পারেনি। আর সমগ্র গ্লোবাল সাউথের মন জেতাও বাকি এখনও বেইজিংয়ের। জরিপ বলছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সমর্থন কাছাকাছি। আফ্রিকায় জনমত পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা আফ্রোব্যারোমিটার অবশ্য লক্ষ করেছে, আফ্রিকায় যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পড়তির দিকে। ২০২২ সালে আফ্রিকায় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সমর্থন ছিল ৪৯ শতাংশ (২০১৯ সালে ছিল ৬০ শতাংশ)। গত মাসে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় একটি জরিপে অংশগ্রহণকারীদের প্রশ্ন করা হয়েছিল, নতুন স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হলে তারা কোন দেশের পক্ষ নেবেন। ৫০.৫ শতাংশ অংশগ্রহণকারী চীনের পক্ষে সমর্থন দিয়েছেন; যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে মত দিয়েছেন ৪৯.৫ শতাংশ অংশগ্রহণকারী। চীন-মার্কিন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দেশগুলোর কোন পক্ষ নেওয়া উচিত—এমন প্রশ্নের জবাবে অধিকাংশই কোনো পক্ষ অবলম্বনের বিরুদ্ধে মত দিয়েছেন।
চীনের আচরণ ও রাজনৈতিক মূল্যবোধ দেশটির প্রভাব কিছুটা খর্ব করতে পারে। ব্যবসা ও রাজনীতিতে দেশটির কার্যকলাপ অনেকের মধ্যে প্রশ্ন তুলেছে। কিছু কিছু দেশ মাঝে মাঝে তাদের ঋণ সংকটের জন্য চীনের দিকে আঙুল তোলে। কঙ্গো ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ দেশে চীনা মাইনাররা পশ্চিমাদের মতোই শোষণদের অভিযোগে অভিযুক্ত। চীনের সিংহভাগ ঘনিষ্ঠ মিত্রই মূলত একদলীয় বা একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্র। বেইজিং কোনো দেশের রাজনৈতিক মূল্যবোধ নিয়ে প্রশ্ন তোলে না। একে তারা হস্তক্ষেপ না করার নীতি বলে প্রচার করে। গ্লোবাল সাউথের যেসব দেশে মজবুত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রয়েছে—যেমন ব্রাজিল—ওইসব দেশের সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠ সাংস্কৃতিক যোগাযোগ স্থাপনের সম্ভাবনা কম।
এছাড়া চীনের অর্থনৈতিক জনপ্রিয়তাও কমতে পারে। বেইজিং বিভিন্ন দেশকে যে ঋণ দিয়েছে, তা এখনও ঠিকমতো পরিশোধ শুরু হয়নি। বিআরআইয়ের আওতায় দেওয়া ৭৫ শতাংশ ঋণের আসল পরিশোধ করতে হবে ২০৩০ সালের মধ্যে। ঋণের অর্থ ফেরত দিতে শুরু করায় বেইজিনংয়ের জনপ্রিয়তাও একটু একটু করে কমতে শুরু করেছে। আফ্রোব্যারোমিটারের তথ্যমতে, চীনকে নিজেদের প্রবৃদ্ধির জন্য ভালো মনে করা আফ্রিকানের সংখ্যা ২০২২ সালে কমে ৪৯ শতাংশে নেমে এসেছে—২০১৯-এ যা ৫৯ শতাংশ ছিল। চীনের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানে শি জিনপিং ব্যাপক শিল্প-ভর্তুকি দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন। এর ফলে অন্যান্য উদীয়মান অর্থনীতির দেশ চীনে উৎপাদিত পণ্যে সয়লাব হয়ে যেতে পারে। এতে অল্প কিছু ক্রেতা লাভবান হলেও আরেকটি 'চীনা ধাক্কায়' গ্লোবাল সাউথের অন্যান্য সরকার কারখানা নির্মাণ বন্ধ করে দিতে পারে।
এসব সমস্যার মোকাবিলা চীন ভালোভাবেই করছে। কিন্তু এর মধ্যে তার জন্য গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে আসছে গ্লোবাল সাউথের অন্যান্য উদীয়মান প্রতিদ্বন্দ্বী। এই প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে প্রথমেই রয়েছে ভারত। পিসিআইএফের তথ্যানুসারে, ভারতের অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক ও সামরিক সংযোগ বাড়ছে। এর সুবাদে ২০৪৫ সাল নাগাদ ক্ষমতার দিক থেকে ব্রিটেন ও ফ্রান্সকে পেছনে ফেলে দেবে ভারত। নয়াদিল্লির সামনে তখন থাকবে ওয়াশিংটন ও বেইজিং। ২০১২ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে আফ্রিকায় ভারতীয় দূতাবাসের সংখ্যা ২৫ থেকে বেড়ে ৪৩-এ দাঁড়িয়েছে। নরেন্দ্র মোদির তথ্যানুযায়ী, আফ্রিকার চতুর্থ বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার এবং প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) পঞ্চম বৃহত্তম অংশীদার এখন ভারত। এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংক অভ ইন্ডিয়া গত এক দশকে আফ্রিকার ৪২টি দেশকে ১২ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে বলে জানিয়েছে ব্লুমবার্গ। গত বছর ভারত ২৫টি আফ্রিকান দেশের সঙ্গে সামরিক মহড়ার আয়োজন করেছিল।
মূল্যবোধের ব্যাপারে নয়াদিল্লির দৃষ্টিভঙ্গিও অনেকটাই আলাদা। ভারত যেসব ক্ষেত্রে দক্ষ, সেসব ক্ষেত্রে নিজেকে 'বিশ্বগুরু' মনে করে। নয়াদিল্লি তার ডিজিটাল হাতিয়ার বিক্রি করছে শ্রীলংকা, সিয়েরা লিওন, ইথিওপিয়ার মতো দেশগুলোর কাছে। এসব হাতিয়ারের মধ্যে রয়েছে বায়োমেট্রিক আইডেন্টিটি প্রযুক্তি। ভারত সরকার আফ্রিকায় বেসরকারি হাসপাতাল নির্মাণের জন্য অর্থ দিচ্ছে। আর ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অভ টেকনোলজি গত নভেম্বরে তাঞ্জানিয়ার জাঞ্জিবার দ্বীপে তাদের প্রথম বৈদেশিক ক্যাম্পাস স্থাপন করেছে।
ভারতের কিছু ক্ষমতা ঠিক পরিমাপযোগ্য নয়। দেশটির গণতন্ত্র ত্রুটিপূর্ণ, কিন্তু পররাষ্ট্রনীতি অতি-বাস্তববাদী। নয়াদিল্লি এদিকে যেমন ওয়াশিংটনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে, অন্যদিকে ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য মস্কোর নিন্দা জানাতেও রাজি হয়নি। জি৭৭-এর সদস্যদেশগুলোর মধ্যে চীনের চেয়ে অনেক বেশি মধ্যপন্থি দর্শন নিয়ে চলে ভারত। ভারত যেভাবে নেতৃত্ব দিতে চায়, তা-ও অনেক আলাদা। দেশটি আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন বদলানোর ব্যাপারে অনেক বেশি বাস্তববাদী। নয়াদিল্লি পশ্চিমা দুনিয়ায় সেতু হতে যায়, সেতুবিধ্বংসী হাতুড়ি নয়।
অন্যান্য দেশগুলোরও নিজস্ব দাবি রয়েছে। চীন যদি প্রভাবের সুপারমার্কেট হয়, তাহলে গ্লোবাল সাউথে তার প্রতিদ্বন্দ্বীরা বুটিকের দোকানের মতো। ছোট দোকানগুলোর বিক্রির সক্ষমতারও কম। উপসাগরীয় দেশগুলো জীবাশ্ম জ্বালানি তেল বেচে যে টাকা পায়, তার কিছুটা ব্যয় করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সবুজ জ্বালানি প্রকল্পে। আফ্রিকান অবকাঠামো প্রকল্পগুলোতে চীনাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছে তুর্কি প্রতিষ্ঠানগুলো। তুর্কি কোম্পানিগুলো পূর্ব আফ্রিকায় রেলপথ, রুয়ান্ডায় জাতীয় স্টেডিয়াম এবং সেনেগাল ও নাইজারে বিমানবন্দর নির্মাণ করেছে।
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম কৃষিপণ্য রপ্তানিকারক ব্রাজিল। দেশটি জি২০-র চেয়ারম্যান। এ পদ ব্যবহার করে ব্রাজিল গ্লোবাল সাউথে খাদ্য নিরাপত্তা বাড়াতে কাজ করছে। ফেব্রুয়ারিতে লুলা ডা সিলভা আফ্রিকান ইউনিয়নের বার্ষিক সভায় এ বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন। পশ্চিমা দুনিয়ার কারও কারও কাছে হাস্যকর মনে হতে পারে, কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকা নিজেকে গ্লোবাল সাউথের নৈতিক নেতা হিসেবে দেখে। দেশটি ইসরায়েলকে গণহত্যার দায়ে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে টেনে নিয়ে গেছে। এছাড়া ইউক্রেন ও রাশিয়ায় আফ্রিকান দেশগুলোর 'শান্তি মিশনের' নেতৃত্বও দিচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকা।
তবে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা নেতৃত্বের দৌড় থেকে এখনও ছিটকে যায়নি। ওইসিডি গ্রুপের ধনী দেশগুলো বছরে ২০০ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দেয় বিভিন্ন দেশকে। অন্যদিকে চীনের অর্থায়নের সিংহভাগই দেওয়া হয় ঋণ হিসেবে। গত ২০ বছরে মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো ব্রিকস ব্লকে (চীন বাদে) এফডিআই হিসেবে ৫১৫ ডলার খরচ করেছে; অন্যদিকে চীনা কোম্পানিগুলো বিনিয়োগ করেছে মাত্র ২১৫ বিলিয়ন ডলার। আইএমএফের তথ্যমতে, সাব-সাহারান আফ্রিকা এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরো অঞ্চলে মধ্যে মোট যে পরিমাণ বাণিজ্য হয়, তা ওই অঞ্চলের সঙ্গে চীনের মোট বাণিজ্যের চেয়ে অনেক বেশি।
ন্যাটোর মতো মিত্র ছাড়াও আরও ৭৬টি দেশের সঙ্গে প্রতিরক্ষা অংশীদারত্ব রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। ধনী ব্যক্তি ও অর্থনৈতিক অভিবাসীরা উন্নত জীবন ও সন্তানের শিক্ষার জন্য পশ্চিমা বিশ্বকেই পছন্দ করেন বেশি।
পশ্চিমা দুনিয়া তার দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। এইডডাটা বলছে, ২০২১ সালে জি৭ চীনের চেয়ে বেশি অবকাঠামো প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ডেভেলপমেন্ট ফাইনান্স কর্পোরেশন উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ঋণ দিতে বা ব্যবসায় শেয়ার কিনতে ৬০ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স চায় বিশ্বব্যাংক যেন সবুজ প্রযুক্তিতে আরও বেশি বিনিয়োগ ও ঋণ দেয়।
এ লড়াইয়ে জিতবে কে?
চীন খুব সম্ভব এ প্রতিযোগিতায় জিততে চায়। আর যদি জিতে যায়ও, তারপরও চীন এমন একটি দলের নেতা হবে যে দলের সদস্যদের মধ্যে শক্তিশালী বন্ধন নেই। গত নভেম্বরেই ব্রাজিলে লুলা গ্লোবাল সাউথের বিষয়ে বলেছেন, 'আমাদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টিকারী বিভেদের চাইতে আমাদের ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম স্বার্থের সংখ্যা অনেক বেশি।'
সত্যি বলতে কী, সর্বত্রই বিভাজন রয়েছে। জাতিসংঘে ইউক্রেন-সংক্রান্ত ভোটে ৪০টির বেশি দেশ নিয়মিত ভোটদানে বিরত থেকেছে অথবা রাশিয়াকে সমর্থন দিয়ে গেছে। গ্লোবাল সাউথে গত ৩০ বছরে ৭৮ শতাংশ পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী মাত্র ৮ শতাংশ দেশ। ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো যেসব মধ্যম আয়ের দেশ জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর অতিনির্ভরশীল, ওইসব দেশের সঙ্গে স্বল্প জ্বালানি ব্যবহার করা দরিদ্র দেশগুলোর লক্ষ্য মেলে না। একদল 'ন্যায্য রূপান্তরের' জন্য টাকা চায়; আরেক দল নিজেদের উন্নয়ন এগিয়ে নিতে আরও বেশি বিদ্যুৎ চায়।
চীন ও অন্য দেশগুলোর একটি লক্ষ্যে মিল রয়েছে—আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পশ্চিমাদের প্রভাব খর্ব করা। কিন্তু পরিস্থিতি জটিল হতে বেশি সময় লাগে না। চীন অদূর ভবিষ্যতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হিসেবে ভারতকে অন্তর্ভুক্ত হতে দেবে না। ডব্লিউটিওতে কৃষি বিষয়ে ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকার মধ্যে নিয়মিতই মতবিরোধ দেখা যায়। বিশ্বব্যাংক বা আইএমএফের সংস্কার থেকে চীনের মতো ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতা দেশগুলোর চাওয়াও আলাদা।
চীন অচিরেই দেখবে গ্লোবাল সাউথের দেশগুলো নিজস্ব স্বার্থ রক্ষা করতে চায়। আর তা করতে গিয়ে দেশগুলো পশ্চিমা বিশ্ব ও চীনের সঙ্গে—এমনকি নিজেদের মধ্যেও—বিরোধে জড়িয়ে পড়বে। অন্যভাবে বললে, গ্লোবাল সাউথ আসলে কোনো নেতা চায় না। এটি প্রতিযোগিতার ময়দান। কোনো মানচিত্রে এই প্রতিযোগিতার ময়দানের অস্তিত্ব নেই।
সৌজন্যে: দি বিজনেস স্টান্ডার্ড