সোমবার   ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪ , ২৪ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

সৈকত ইসলাম

প্রকাশিত: ২৩:১৪, ২০ এপ্রিল ২০২৪

খাদ্য নিরাপত্তা ও খাদ্য সার্বভৌমত্ব

খাদ্য নিরাপত্তা ও খাদ্য সার্বভৌমত্ব

খাদ্য নিরাপত্তা শব্দটির সাথে আমরা খুব পরিচিত। খাদ্য নিরাপত্তা একটি মৌলিক  মানবাধিকার হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে বারবার স্বীকৃত হয়েছে। বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তা সংক্রান্ত রোম ঘোষণায় বলা হয়েছে সমস্ত মানুষের, সবসময়, পর্যাপ্ত, নিরাপদ এবং পুষ্টিকর খাদ্য শারীরিক এবং অর্থনৈতিক ভাবে পাওয়ার সক্ষমতা থাকাকে খাদ্য নিরাপত্তা বলে। 

আপাত দৃষ্টিতে খাদ্য নিরাপত্তার এই সংজ্ঞাকে  মৌলিক চাহিদা হিসেবে খাদ্য নিশ্চিত করার জন্য পূর্ণাঙ্গ মনে হতে পারে। কিন্তু সমস্যা হল খাদ্য নিরাপত্তায় খাদ্য কোথা থেকে আসে বা  এই খাদ্যের যোগান কোন পরিস্থিতিতেকে তরান্বিতত করতে পারে তা বিবেচনায় নেয় না। 

খাদ্য নিরাপত্তার মূল লক্ষ্যই হল খাদ্য সরবরাহ ঠিক রাখা। কিন্তু এই সরবরাহ ঠিক রাখতে গিয়ে উৎপাদন প্রক্রিয়া কি পরিবেশগতভাবে ধ্বংসাত্মক এবং শোষণমূলক অবস্থার অধীনে পরিচালিত হচ্ছে কি না বা এমন ভাবে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে কি না যা স্থানীয় খাদ্য উৎপাদকদের ধ্বংস করে কিন্তু কৃষি ব্যবসা কর্পোরেশনগুলিকে উপকৃত করে, এই বিষয়গুলো অনেকটাই গৌন থাকে। কিন্তু এই গৌন বিষয়গুলো কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ন একটি বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে।  

কর্পোরেট-নিয়ন্ত্রিত কৃষি বাজার ব্যবস্থা বৃহৎ মাপের কৃষির সম্প্রসারণকে সহজতর করে যার ফলে শ্রম সাশ্রয় করে অটোমেশন এর মাধ্যমে কৃষি পণ্যের বৃহৎ উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যাওয়া সম্ভব হয়।  ফলশ্রুতিতে উৎপাদন যেমন বৃদ্ধি পায় তেমনি  কর্পোরেশন গুলোকে তাঁদের  কৃষি পণ্যের  রপ্তানি করতে উৎসাহিত করে। এতে উৎপাদন একদিকে বৃদ্ধি পায় কিন্তু অন্যদিকে এটি কৃষি খাতের রূপান্তর ঘটায় এবং গ্রামীণ শ্রমিক শ্রেণীর জীবিকাকে চ্যালেঞ্জ করে। স্থানীয়  কৃষি অর্থনীতি থেকে সম্পদ আহরণ করে, কৃষি পণ্যের দাম এবং  চাহিদাকে কর্পোরেশনের  উপর অত্যন্ত নির্ভরশীল করে তোলে। 

এমন পরিস্থিতিতে খাদ্য নিরাপত্তার জন্য খাদ্য উৎপাদন বা সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার বাইরেও একটি বড় বিষয় নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তা রয়ে যায় যাকে বলা হয় খাদ্য সার্বভৌমত্ব। খাদ্য সার্বভৌমত্ব হল এমন একটা অবস্থা নিশ্চিত করা যেখানে খাদ্য উৎপাদন ও ভোগ কৃষক ও  কৃষক পরিবার -চালিত কৃষি, মৎস্যজীবী চালিত -মাছ ধরা, পশু-পালনজীবি পরিচালিত পশু-পালনের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন, বিতরণ এবং ভোগকে ক্ষমতায়ন করা।

খাদ্য সার্বভৌমত্ব শব্দটি সর্বপ্রথম ১৯৯৩ সালে La Via Campesina,দ্বারা ব্যবহৃত হয়েছিল। এটি ছিল ছোট-বড় কৃষক,  কৃষি শ্রমিক এবং আদিবাসী গোষ্ঠীগুলির একটি আন্তর্জাতিক আন্দোলন  পরবর্তীতে  এটিকে পরিবেশগতভাবে উৎপাদিত স্বাস্থ্যকর এবং সাংস্কৃতিকভাবে উপযুক্ত খাদ্যের জন্য জনগণের অধিকার হিসাবে সংজ্ঞায়িত হয়। এক কথায় এটি ছিল কৃষক, কৃষি শ্রমিক এবং আদিবাসী গোষ্ঠীগুলির সঠিক এবং টেকসই পদ্ধতি, এবং তাদের নিজস্ব খাদ্য ও কৃষি ব্যবস্থাকে সংজ্ঞায়িত করার অধিকার।   

গত শতকের ৯০ এর দশকের প্রথম  দিকে কৃষি ব্যবস্থায় একটি শিল্পায়িত মডেলের আবির্ভাব ঘটে। কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত কৃষি ও খাদ্য পণ্যের এই শিল্পায়িত মডেল স্বল্প উন্নত দেশের খাদ্য ব্যবস্থায় শোষণ, স্থানচ্যুতি এবং গভীর বৈষম্য সৃষ্টি করেছিল। এর  বিরোধিতায়  আবির্ভূত হইয়েছিল লা ভায়া ক্যাম্পেসিনা  বা খাদ্য সার্বভৌমত্ব আন্দোলন।

খাদ্য সার্বভৌমত্ব শব্দটি উদ্ভাবিত হওয়ার পর থেকে, এটি একটি বিকেন্দ্রীভূত আন্দোলন হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত  অর্জন করেছে। এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য হল ক্ষুদ্র আকারের স্থানীয় খাদ্য উৎপাদকদের খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও বিতরণ করতে উৎসাহিত করে, খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থায় বহুজাতিক কর্পোরেশনের প্রভাব কমিয়ে আনা।   

গত কয়েক দশকের কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থায়  বিশ্ব বাণিজ্যে একটি উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থার শুরু দেখা যায় যা হল বিশ্বব্যাপী সমন্বিত উৎপাদন ব্যবস্থা বা গ্লোবাল ভ্যালু চেইন (GVC) এর মাধ্যমে পণ্য উৎপাদন ও বাজরজাত । এই সমন্বিত উৎপাদন ব্যবস্থায় উন্নত দেশগুলি সাবকন্ট্রাক্টিং এবং আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে পণ্য উৎপাদনের  জন্য উন্নয়নশীল এবং স্বল্পোন্নত দেশগুলির  উপর নির্ভর করে  যেখানে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলি তাঁদের তুলনামূলক কমমূল্যের শ্রম ব্যবহার করে পণ্য উৎপাদন করে আর উন্নত দেশগুলি পণ্যের ডিজাইন ও  সমাপ্ত পণ্যের বিপণন এর কাজ করে থাকে। 

আরও নির্দিষ্টভাবে বললে সমন্বিত উৎপাদন ব্যবস্থা হল  সেই ধারণা যেখানে এক দেশে কাঁচামাল উত্তোলন করা হয় অন্য দেশে পণ্য তৈরির জন্য প্রক্রিয়াজাত করা হয় এবং শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত ব্যবহারের জন্য অন্য আরেকটি দেশে রপ্তানি করা হয়।  এই ব্যবস্থায় সবচেয়ে বড় উদাহারণ হল  স্বল্প উন্নত দেশ গুলোর তৈরি পোশাক শিল্প। এই মডেলটি শিল্প পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে স্বল্প উন্নত দেশগুলোকে কিছু বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ দেওয়ায় এবং স্বল্প দক্ষ শিল্প খাতে কিছু কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করায় তা শিল্প অনুন্নত দেশগুলোর জন্য অনেকাংশেই শিল্পায়নের একমাত্র  বিকল্প হিসেবে গ্রহনযোগ্য হয়েছে।

একই ভাবে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান গুলো যখন কৃষি ও খাদ্য পণ্যে তাঁদের বাজার তৈরি করত চায় তখন তাঁদের প্রধান লক্ষ্যই থাকে যেখানে শ্রম এবং উৎপাদন খরচ সবচেয়ে কম সেখানে উৎপাদন ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ নেওয়া যা তাঁদেরকে সস্তা পণ্যের যোগান নিশ্চিত রেখে তাঁদের পণ্যকে বাজারে সবচেয়ে বেশি প্রতিযোগী করে তুলতে পারে। 

বর্তমানে অনেক স্বল্পোন্নত দেশের পোশাক শিল্পই তাদের অতীতের গৌরবজ্জ্বল দিন হারিয়ে শুধু মাত্রই স্বল্প শ্রম যোগান দেওয়ার কারখানায় পরিণত হয়েছে। কিন্তু শিল্প পণ্যে যা মেনে নিয়ে চলা সম্ভব কৃষি বা খাদ্য পণ্যে তা কতখানি সম্ভব তা ভাবা প্রয়োজন। 

তাই দাম বেশি এই কারণ দেখিয়ে স্থানীয়ভাবে উৎপন্ন কৃষি ও খাদ্য পণ্য না কেনার ক্যাম্পেন করে কম দামি পণ্য পেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলার আগে অন্তত একবার ভাবা প্রয়োজন খাদ্য নিরাপত্তার জন্য খাদ্য সার্বভৌমত্ব হুমকিতে পড়ছে কি না। শেষ পর্যন্ত কিন্তু খাদ্য সার্বভৌমত্বই প্রকৃত খাদ্য নিরাপত্তার পূর্বশর্ত।

সর্বশেষ

জনপ্রিয়